মন্দবাগ ট্র্যাজেডি: এসএসসি’র ফরম পূরণ করা হলো না ফারজানার
১৫ নভেম্বর ২০১৯ ১০:৫৫
ঢাকা: চাঁদপুর সদরের বালিয়া ইউনিয়নের বাগাদি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারজানা। সামনের বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। খালার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ৭ নভেম্বর মা, নানী, মামী ও ভাই-বোনের সঙ্গে সেও রওনা হয় শ্রীমঙ্গলের পথে। এদিকে, এসএসসির ফরম পূরণের শেষ দিন ১৪ নভেম্বর। তাই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই ১২ নভেম্বর শ্রীমঙ্গল থেকে উদয়ন এক্সপ্রেসে চড়ে ফের বাড়ির পথে রওনা দেয় ফারজানা। ট্রেন থেকে লাকসাম স্টেশনে নেমে সেখান থেকে চাঁদপুর যাওয়ার কথা ছিল তাদের। এরপর ১৩ নভেম্বর না পারলেও শেষ তারিখ ১৪ নভেম্বর ফরম পূরণ হবে— এমনটিই ভেবেছিল ফারজানা।
তবে আর বাড়ি ফেরা হয়নি ফারজানার। এসএসসির ফরমও পূরণ করা হয়নি। উদয়ন এক্সপ্রেসের ওই যাত্রাই হলো তার জীবনের শেষ যাত্রা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ স্টেশনে নিশীথা তূর্ণা এক্সপ্রেসের সঙ্গে উদয়ন এক্সপ্রেসের ভয়াবহ সংঘর্ষে তার সঙ্গে থাকা পরিবারের সব সদস্যই আহত হয়ে এখন কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে। আর ফারজানা পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।
মামাত বোনের সঙ্গে ফারজানা
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর, পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত) গেলে কথা হয় ফারজানার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। কথা হয় তার কুয়েত প্রবাসী বাবা বিল্লাল হোসেন বেপারীর সঙ্গেও। মঙ্গলবারের (১২ নভেম্বর) ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়েই তিনি বুধবার (১৩ নভেম্বর) ছুটে এসেছেন দেশে। কিন্তু যে মেয়েকে চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন বিল্লাল, তড়িঘড়ি করে দেশে ফিরেও সেই মেয়েকে শেষবারের জন্য দেখতে পাননি তিনি। এর আগেই দাফন হয়ে গেছে ফারজানার।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে কুয়েত থেকে দেশে ফিরেছেন বিল্লাল হোসেন, কিন্তু মেয়েকে শেষ দেখা দেখতে পাননি
বিল্লাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি কুয়েতে থাকি। মেয়ে আমার সামনের বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। কুয়েতে আমার কলিগরা মেয়ের বিয়ের কথা বলত। কিন্তু আমি বলতাম, মেয়েকে বিয়ে দেবো না এখন। মেয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছিল। আমিও বলতাম, তুই পড়ালেখা কর। ডাক্তার বানানোর জন্য যা দরকার হয়, সব করব। কিন্তু মেয়ে আমার এসএসসি পরীক্ষার ফরমটাই ফিলআপ করতে পারল না। কী বলব, মেয়ে আমার দুনিয়াতে নাই, সেইটাই তো আমি জানতাম না। মেয়েরে শেষবারের মতো দেখতেও পেলাম না।’
হাসপাতালের বেডে ফারজানার মা রোজিনা বেগম
এক মেয়ে ও দুই ছেলের জনক বিল্লাল হোসেন। মন্দবাগের ট্রেন দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পরই তিনি জানতে পারেন, দুর্ঘটনা কবলিত একটি ট্রেনে ছিলেন তার পরিবারের সবাই। দ্রুত যোগাযোগের চেষ্টাও করেন সবার সঙ্গে। কিন্তু শুরুতে তাকে জানানো হয়নি, ফারজানা আর নেই। পরিবারের বাকি সবাই যে আহত— সে তথ্যও গোপন করা হয় তার কাছে।
বিল্লাল বলেন, এখন তো দুনিয়াটা ছোট। সব খবর ইউটিউব, ফেসবুক, ইমোতে পাওয়া যায়। সেই ট্রেনেই ওরা যাচ্ছিল, এটা জানতাম। আর তাই দুর্ঘটনার খবর পেতেই সবাইকে ফোন করতে শুরু করি। কিন্তু কেউ বলছিল না কে কোথায় আছে। সবাই শুধু বলছিল, ওরা ভালো আছে। কিন্তু আমার তো মন মানছিল না।
হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন ফারজানার নানী
একই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ফারজানার ভাই হাসান বেপারি, মামী শাহিদা বেগম, নানী ফিরোজা বেগম, মামাত বোন মিতু, ইলমা ও মামাত ভাই জুবায়ের। প্রথমে তাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য। পরে সেখান থেকে পাঠানো হয় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। পরে ইলমা ও জুবায়ের বাদে বাকি সবাইকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে। সেখান থেকে বুধবার তাদের পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
তিনি বলেন, খবর নেওয়ার জন্য ফোন করি আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম মিয়াজীকে। জিজ্ঞাসা করি, ওদের কী হয়েছে? সিলেট থেকে এখনো বাড়ি যাচ্ছে না কেন ওরা? চেয়ারম্যানও আমাকে কিছু বলেন না। এরপর আবার বাড়িতে ফোন করে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। আমাকে বলে, ও ঘুমাচ্ছে। সাত-আট ঘণ্টা পর আবার যখন ফোন করি, ফারজানার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তখন আমাকে বলে, ফারজানা আর কখনো আমাদের সঙ্গে কথা বলবে না। সে আর কখনো ঘুম থেকে উঠবে না।
কান্না থামিয়ে রাখতে পারেন না বিল্লাল হোসেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্ত্রীর বেডে বসে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, বুকটা আমার মোচড় দিয়ে ওঠে। মেয়ে আমার ডাক্তার হতে চেয়েছিল। সে স্বপ্ন পূরণ হলো না। মেয়েটাকে শেষবারের মতো দেখতে পর্যন্ত পেলাম না।
ফারজানার মামাত বোন
বিল্লাল জানান, দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যায় ফারজানা। তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে। সেখানে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ নিতে গিয়েছিলেন চাঁদপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছিম উদ্দিন। তবে এলাকাবাসী ও ফারজানার বন্ধুরা ময়নাতদন্ত করতে দিতে রাজি হননি। পরে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয় ফারজানার মরদেহ।
হাসপাতালের সিডি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ফারজানার মা রোজিনা বেগম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়ের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলআপের শেষ দিন ছিল আজ (বৃহস্পতিবার)। তাই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করেই বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হই। ট্রেনে আমরা চারজন সামনাসামনি বসেছিলাম। ফারজানা আমাদের বাম দিকের সারিতে ওর মামাত বোনের সঙ্গে বসেছিল। তখন আমরা চা খাচ্ছিলাম। এর একটু পরই এক বিকট শব্দ। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। কে কোথায়, কোনো ঠিক নেই। মেয়েটার মুখে আর আম্মু ডাক শুনতে পাই নাই।’ বলতে বলতেই কান্না করে ওঠেন রোজিনা বেগম।
ফারজানার ভাই
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত ১৩ জন বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের মধ্যে ৫২ বছর বয়সী আবুল কালামের শারীরিক অবস্থা কিছুটা গুরুতর। আশা করছি তিনিও খুব দ্রুতই স্থিতিশীল অবস্থায় চলে আসবেন। বাকিদের মধ্যে সুমিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। খুব দ্রুতই সে ফিরে আসবে বলে আশা করছি। বাকিদের সবার অবস্থা এখন আগের চাইতে স্থিতিশীল।
ফারজানার মামী
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) ভোর পৌনে ৪টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেসের সঙ্গে সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় ১৬ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক।
উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনা তূর্ণা এক্সপ্রেস ফারজানা মন্দবাগ ট্র্যাজেডি