পেঁয়াজ উৎপাদন ও সংরক্ষণে জরুরি সচেতনতা
১৮ নভেম্বর ২০১৯ ২২:৫৩
পৃথিবী জুড়ে বাঙালির ভোজন বিলাসিতার খ্যাতি রয়েছে। নানাবিধ মসলার সমন্বয়ে বাঙালির রন্ধনশৈলীর উপস্থাপনা যেকোনো মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যে হারে মসলার ব্যবহার হয়ে থাকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে তা লক্ষ্য করা যায় না। আবার খাবারকে রুচিশীল ও মুখরোচক করতে মসলার বিকল্প নেই। পেঁয়াজকে শুধু মসলা বললে ভুল হবে। কারণ পেঁয়াজ একাধারে মসলা এবং সবজিও বটে। ভাতের সঙ্গে শুধু পেঁয়াজ, সালাদ ও ঝাল মুড়িতে কাঁচা পেঁয়াজ এবং আলু, বেগুন, ডিম ও শুটকি ভর্তায় এমনকি ডিম ভাজতেও এর ব্যবহার সমাদৃত। এছাড়া পেঁয়াজ মসলা হিসেবে বেটে পেস্ট বানিয়ে তরকারিতে ব্যবহার করা হয়। পেঁয়াজ পাতায় বেশি পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে। সেজন্য এই পাতাকে সবজি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাছাড়া পেঁয়াজের ডাটা ও পাতা ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। পেঁয়াজ ব্যবহৃত খাবার দ্রুত হজম হয় এবং রুচিবর্ধক বটে।
বাংলাদেশে সাধারণত ৩টি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়-
১. জমিতে সরাসরি বীজ বপন করে।
২. কন্দ/বাল্ব সরাসরি রোপন করে।
৩. বীজতলা থেকে তৈরি চারা সংগ্রহ করে অন্যত্র রোপন করে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের আবহাওয়া আর বাংলাদেশের আবহাওয়া এক নয়। ভারত, উজবেকিস্থান, মিশরসহ আরও কিছু দেশে ২ থেকে ৩ মৌসুমে পেঁয়াজ চাষ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে শুধুমাত্র রবি মৌসুমেই পেঁয়াজের চাষ করা হয়। বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ দশমিক ৩০ লাখ মেট্রিক টন। সনাতন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করায় প্রতিবছর উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ পর্যায়ে মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়। সে হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট উৎপাদনের ৭ থেকে ৮ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। পেঁয়াজ সংগ্রহ/উঠানোর উপযুক্ত সময় হলো ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস। তবে এ ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় নিচু ও মাঝারি নিচু এবং মাঝারি উঁচু জমির পেঁয়াজ ক্ষেতে পানি জমে যায়। ফলে কৃষকেদের জমি থেকে ভেজা পেঁয়াজই উত্তোলন করতে হয়। এতে পেঁয়াজে জলীয় অংশের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে সংরক্ষণকালীন সময়ে পেঁয়াজের বড় একটি অংশ দ্রুত পচে নষ্ট হয়ে যায়। এই নষ্ট হয়ে যাওয়া পেঁয়াজের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ শতাংশ। সে হিসেবে আরও সোয়া এক লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। তাহলে সব হিসাব শেষে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ থেকে ১৪ দশমিক ৮৪ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু আমাদের দেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদা রয়েছে ২৪ থেকে ২৫ লাখ মেট্রিক টন। ফলে এ বছর প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ মেট্রিক পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুত্র মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৯১ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ পর্যন্ত আমদানি করা পেঁয়াজের পরিমাণ প্রায় ২ দশমিক ৩০ লাখ মেট্রিক টন।
এ বছর পেঁয়াজ পচে যাওয়ার ভয়ে চাষীরা ভরা মৌসুমেই কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করেছে। এ কারণে মৌসুম পরবর্তী সময়ে চাহিদার তুলনায় দেশীয় পেঁয়াজ কম পরিমাণে সংরক্ষিত ছিল। ফলে বর্তমানে কৃষকের কাছে দেশি পেঁয়াজ নেই বললেই চলে। বর্তমানে কিছু মুনফাভোগীর কাছে অল্প পরিমাণে পেঁয়াজ সংরক্ষিত আছে। এবং তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেশি মুনাফায় বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। এ বছর একদিকে যেমন কৃষক তার ন্যায্য মূল্য পায়নি, অন্যদিকে ভোক্তরাও ন্যায্য মূল্যে পণ্যটি কিনতে পারছে না। কৃষি বান্ধব এই সরকারকে বিপদে ফেলতে কিছু ব্যবসায়ী কম দামে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ কিনে ভোক্তার কাছে বেশি দামে বিক্রি করছে। এজন্য সরকারের উচিত পচনশীল এই পণ্যটি সারাবছর সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অধীনে কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা; যাতে কৃষকের উৎপাদিত পেঁয়াজের সংরক্ষণ করে ভোক্তার কাছে ন্যায্য মূল্যে বিতরণ করা যায়। এছাড়া পেঁয়াজ চাষীদের তালিকা তৈরি করে প্রণোদনা প্রদান এবং এই ফসলটির চাহিদাভিত্তিক আবাদ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বর্ষা মৌসুমে আবাদের জন্য পেঁয়াজের ৩টি জাত অবমুক্ত করেছে। জাতগুলো হলো- বারি পেঁয়াজ ২, বারি পেঁয়াজ ৩, বারি পেঁয়াজ ৫। এই জাতগুলো ফেব্রুয়ারি মাসে বীজতলায় রোপন করে মার্চ মাসে মূল জমিতে আবাদ করে জুন-জুলাইয়ে সংগ্রহ করা যায়। আবার জুলাইয়ে বীজতলায় বোপণ করে আগস্টে মূল জমিতে আবাদ করে নভেম্বরে সংগ্রহ করা যায়। এ জন্য বর্ষামৌসুমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করতে হবে। কিন্তু এ সময় বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় এবং তাপমাত্রা বেশি থাকায় সময়োপযোগী জাত অবমুক্ত করতে হবে। তাহলে সংগ্রহোত্তর ও সংরক্ষণকালীন অপচয় বাদ দিয়ে অতিরিক্ত প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
আমাদের দেশে পেঁয়াজের স্থানীয় জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে তাহেরপুরী, ফরিদপুরী ও ঝিটকা। প্রতি হেক্টর জমিতে এই জাতগুলোর গড় ফলন ৭ থেকে ১০ মেট্রিক টন। এছাড়া মেহেরপুর জেলায় ভারতের সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজ আবাদ হয়। প্রতি হেক্টরে এই জাতের পেঁয়াজের গড় ফলন ৩৫ থেকে ৪০ মেট্রিক টন। কিন্তু এ জাতের পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা কম থাকায় জাতটি কৃষক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লালতীর সিড লিমিটেডের ২০টি জাত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লালতীর কিং ও লালতীর হাইব্রিড। প্রতি হেক্টর জমিতে এগুলোর ফলন ১২ থেকে ১৫ মেট্রিক টন। এই জাতের পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা দেশি জাতের চেয়ে কম। ফলে এই জাতগুলোও যথাযথভাবে সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় হচ্ছে না।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ২৭ হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে কন্দ পেঁয়াজ আবাদ হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান অর্থবছরের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত কন্দ পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে ২২ হাজার ৪৩৮ হেক্টর জমিতে। সে অর্থে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও রবি মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাতের কারণে কন্দ পেঁয়াজ আবাদ দেরিতে শুরু হয়েছে। বাজারে সাধারণত নভেম্বরের শেষ দিকে মুড়ি ও কন্দ পেঁয়াজ উঠতে শুরু করে। কিন্তু এবার কন্দ পেঁয়াজ আসতে একটু বিলম্ব হওয়া এবং নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ না থাকাও দাম বাড়ার একটি কারণ।
পেঁয়াজ মসলা জাতীয় ফসল। স্থানভেদে এক একর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। আর প্রতিবারের আবাদ থেকে একর প্রতি আসে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা। তবে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে মৌসুমের বাইরে আরও বেশি মুনাফা সংগ্রহ করা যায়। পেঁয়াজ সংরক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত হলে চাষীরা পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবে।
সংরক্ষণ পদ্ধতি
পেঁয়াজ ভালো করে শুকানোর পর গুদামজাত করতে হবে। গুদাম ঘর ঠাণ্ডা ও বায়ু চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। মাঝে মাঝে গুদাম ঘর পরীক্ষা করে পচা ও রোগাক্রান্ত পেঁয়াজ বেছে সরিয়ে ফেলতে হবে। গুদাম ঘরের তাপমাত্রা হতে হবে ৩৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং ৬৪ শতাংশ আর্দ্রতাযুক্ত। কাঁচা পেঁয়াজ কাগজের ব্যাগে ছিদ্র করে রেখে ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য আধুনিক উন্নত পদ্ধতি হলো ’জিরো এনার্জি স্টোরেজ’ পদ্ধতি। মূলত বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ওই স্টোরেজ তৈরি করা হয়। এরপর এক ধরনের ওষুধ দিয়ে পরিশোধন করে নেওয়া হয়। তারপর সেখানে পেঁয়াজ রাখা হয়। এতে পেঁয়াজ পচে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরক্ষণের জন্য সুপারিশ
১. আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও সংরক্ষণ করতে হবে।
২. সংগ্রহোত্তর ও সংরক্ষণকালীন অপচয় ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
৩. উৎপাদন/ভরা মৌসুমে কৃষকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৪. বর্ষামৌসুমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করতে হবে।
৫. উন্নত ও ভালো মানের বীজ ব্যবহার করতে হবে।
লেখক: কৃষিবিদ, বিসিএস (কৃষি), কন্ট্রোল রুম, খামারবাড়ি