টিভি চ্যানেলগুলোকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়ার দাবি
২১ নভেম্বর ২০১৯ ১৭:৪৯
ঢাকা: দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রত্যাশিতভাবে চলতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে টিভির বিজ্ঞাপনগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যাওয়া প্রতিরোধ করতে হবে। একইসঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে বিজ্ঞাপনের দর। সংবাদপত্রের মতো টিভিগুলোতেও সরকারি বিজ্ঞাপন দিতে হবে। টিভিকর্মীদের জন্য ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের বিষয়টি ভাবতে হবে।
দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরা ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে গণমাধ্যম গুজব প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেয়। আবার রাষ্ট্র বিভিন্ন শিল্পকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দিয়ে থাকে। একইভাবে গণমাধ্যমগুলোকেও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দিতে হবে।
বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়া স্টুডিওতে ‘কেমন আছে আমাদের টেলিভিশন?’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। বিশ্ব টেলিভিশন দিবস উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার ও বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভি। অনুষ্ঠানটি আরটিভিতে সরাসরি সম্প্রচারও হয়।
সেমিনারের প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আগে শত কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বিদেশে চলে যেত। এখন সেটি বন্ধ করা হয়েছে। এখন আর দেশের বিজ্ঞাপন বিদেশি চ্যানেলে যাচ্ছে না। তবে যেসব কোম্পানির বিদেশে রেজিস্ট্রেশন আছে, তারা সেই দেশের টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারছে। টেলিভিশননের সমস্যাগুলো আসলে বহু বছরের পূঞ্জীভূত। আমরা সেগুলো একে একে দূর করার চেষ্টা করছি।
তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ক্যাবল অপারটের সিন্ডিকেটের কাছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো জিম্মি হয়ে গেছিল। আমরা সেই সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বিজ্ঞাপনগুলো যাচ্ছে, তা বন্ধ করা চেষ্টা করা হচ্ছে। ফেসবুক ও গুগলকে দেশের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। অ্যাড সোর্স কোম্পানিগুলো যেন বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে, সে বিষয়টিও নজরদারিতে আনা হচ্ছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা সিরিয়াল প্রচারের ক্ষেত্রে এখন অনুমতি নিতে হচ্ছে। এজন্য একটি বোর্ড বা কমিটি করা হবে।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান বলেন, টেলিভিশনের সমস্যাগুলো আমরা একে একে দূর করা চেষ্টা করছি। গণমাধ্যমকর্মী ও সম্প্রচারণ আইন নিয়েও কাজ চলছে। আইন করতে অনেক সময় লাগে। এ কারণেই একটু সময় লাগছে। আমরা গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা দিতে চাই। আমরা সবসময় গণমাধ্যমকর্মীদের পাশে আছি।
একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাটকোর সিনিয়র সহসভাপতি মোজাম্মেল বাবু বলেন, গণমাধ্যমকে পূর্ণাঙ্গ ব্যবসায়িক দৃষ্টি দিয়েই দেখতে হবে। কারণ গণমাধ্যমের আয় না থাকলে প্রতিষ্ঠান চলবে না। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক পরিকল্পনা থাকতে হবে। গণমাধ্যমের মালিকানার ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ সাংবাদিকদের হাতে ন্যস্ত করা যেতে পারে, তাতে কর্মীরা মালিকদের সমস্যাও অনুভব করতে পারবে।
ইস্টওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নঈম নিজাম বলেন, দেশে কতগুলো আইপি টেলিভিশন আছে, সরকারের কাছে সে তথ্য নেই। সরকারের পক্ষ থেকে আইপি টেলিভিশনগুলোর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। দেশে এতগুলো মিডিয়া দেওয়া হলো, কাকে দেওয়া হলো? তিনি সক্ষম কি না একটি মিডিয়ার ভার বহন করতে? তিনি যদি ব্যক্তিগতভাবে লাইসেন্স বিক্রি করার জন্য নিয়ে থাকেন, তাহলে একটি কথা। প্রতিষ্ঠান চালানোর দৃষ্টিকোণ থাকে, সেটি আরেকটি কথা। আমরা সংবাদকর্মীদের কথা বলছি, যারা নির্মাতা, তাদের ঘুরতে হয় অনুষ্ঠানের টাকা পেতে। এত বছর পরও আমরা টেলিভিশনের জন্য ওয়েজ বোর্ড করতে পারিনি। আমরা কি কোনোদিন তা দাবি করেছিলাম? পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, অথচ টেলিভিশনে তা দেওয়া হয় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি বিজ্ঞাপন বিনামূল্যেই প্রচার করতে হয়। দু’টোই তো গণমাধ্যম, তাহলে পত্রিকা টাকা পেলে টিভি কেন পাবে না?
সারাবাংলা ডটনেট ও জিটিভি’র এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, দুই যুগেও দেশে টেলিভিশনগুলোর কোনো কাঠামো গড়ে উঠেনি। টেলিভিশনের উন্নয়নে সরকারের কাছ থেকে আমরা কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি। পেঁয়াজ ও লবণের সংকট, পরিবহন ধর্মঘট— সবকিছুতেই রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে টেলিভিশনগুলো। প্রতি মুহূর্তে তারা সরকারকে সেফ করছে। রাষ্ট্রকে যারা সেফ করছে, তারাই কিন্তু আজ বিপর্যস্ত অবস্থায়।
ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘আমাদের যে কর্মীরা আছে, সাংবাদিক বলেন, কলাকুশলী বলেন, যারা টেলিভিশনের নাটক নির্মাণ করছে, গান নির্মাণ করছে, নির্মাতা যারা আছেন— প্রত্যেকের অবস্থাই রুগ্ন। এর কারণ, কারও বেতন নেই, কারও আবার টেলিভিশনে পাওনা টাকা রয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে হিউম্যান রিসোর্স চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নয় বলে সাংবাদিকতাকে এখন আর কেউ সুরক্ষার জায়গা ভাবছে না।’
সারাবাংলা ডটনেটের এই এডিটর ইন চিফ বলেন, আমাদের বিজ্ঞাপনগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চলে যাচ্ছে। নানা কারণেই টেলিভিশনের আয় কমছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি উপায় আছে। এটকো’র যতোগুলো চ্যানেল আছে, তা সাবস্ক্রিপশন ছাড়া ক্যাবল অপারেটরগুলো প্রচার করতে পারবে না। এটি যদি কাল থেকেই করা হয়, তাহলে চ্যানেগুলোর আয় বাড়বে। এটকো যদি বলে পেমেন্ট ছাড়া ক্যাবল অপারেটরগুলোকে কোনো চ্যানেল দেওয়া হবে না, তাহলে তা তারা প্রচার করতে পারবে না। ডিজিটাল সিস্টেমের আগেই এটা সম্ভব, যদি সরকার ও এটকোর পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্ত আসে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ জ ম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, দেশের টেলিভিশনগুলোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, ব্যবস্থাপনা, কারিগরি, গুণগত কনটেন্ট, বিদেশি চ্যানেল ও বিদেশে কনটেন্টজনিত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যানেলগুলোর জন্য বিজ্ঞাপন রেট এখনো নির্ধারিত হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১২ মিনিটের জায়গায় ৩০ মিনিট বিজ্ঞাপন দেখাতে হয়। টেলিভিশনগুলোর বিজ্ঞাপন আবার ডিজিটাল মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। বিদেশি চ্যানেগুলো ইউজার জেনারেটর কনটেন্ট তৈরি করছে। প্রতিনিয়ত ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, আইফ্লিক্স, বায়োস্কপে নতুন নতুন কনটেন্ট উন্মুক্ত হচ্ছে। টেলিভিশনের বেশিরভাগ কনটেন্ট খুবই নিম্নমানের বলে অনেকের ভাষ্য। আবার বিদেশি সিরিয়ালের কারণে দেশের সংস্কৃতিতেও প্রভাব পড়ছে। বিদ্যমান যে আইনগুলো, তা বাস্তবায়ন করতে হবে যেন বিদেশি চ্যানেল ও অনলাইনে আমাদের বিজ্ঞাপন না যায়। সম্প্রচার আইন করতে হবে। একইসঙ্গে প্রস্তুত করতে হবে কোয়ালিটি কনটেন্ট।
অনুষ্ঠানে বক্তরা জানান, বর্তমানে কমপক্ষে ১৮টি চ্যানেলে ২ থেকে ৫ বছর ধরে ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রয়েছে। এক থেকে তিন মাসের বকেয়া আছে ৮ থেকে ১০টি চ্যানেলে। ছয় মাসের বকেয়া আছে দুইটি চ্যানেলে। গত একবছরে কমপক্ষে ৯টি চ্যানেল থেকে জনবল ছাটাই করা হয়েছে। বার্তাবিভাগ বন্ধ করা দেওয়া হয়েছে একটি চ্যানেলে। ৩০টি টিভি চ্যানেলের ২৮টিতে নেই গ্র্যাচুইটি, ২৫টিতে নেই প্রভিডেন্ড ফান্ড।
বক্তারা আরও বলেন, সব শিল্পকেই সরকার সুরক্ষা দিয়ে থাকে। গণমাধ্যমকে রক্ষার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফান্ড দিয়ে হলেও গণমাধ্যমগুলোকে রক্ষা করা যায়।
আরটিভি’র ডেপুটি হেড অব নিউজ মামুনুর রহমান খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোচনায় আরও অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক রহমান, একাত্তর টিভির প্রধান পরিকল্পনা সম্পাদক নূর সাফা জুলহাস, নিউজ টোয়েন্টি ফোরের বার্তা প্রধান রাহুল রাহা, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের চেয়ারম্যান রেজওয়ানুল হক রাজা ও সদস্য সচিব শাকিল আহমেদসহ অন্যরা।
গণমাধ্যম গণমাধ্যমের সুরক্ষা টিভি চ্যানেল টিভি দিবস টেলিভিশন চ্যানেল তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বিশ্ব টেলিভিশন দিবস ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা