যেভাবে রায়ের পর্যায়ে পৌঁছালো হলি আর্টিজান মামলা
২৬ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৩৮
ঢাকা: রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৩ বছর পর রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে। বুধবার (২৭ নভেম্বর) রায় ঘোষণার জন্য দিন ঠিক করেছেন আদালত। ৫২ কার্যদিবসের কার্যক্রম শেষে গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান রায়ের জন্য এ তারিখ নির্ধারণ করেন।
২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ মামলার বাদী উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার দাসের সাক্ষ্য নেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। প্রায় একবছর পর গত ২৭ অক্টোবর মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এরপর গত ৩০ অক্টোবর আত্মপক্ষ শুনানিতে আট আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।
চলতি মাসের ৬ নভেম্বর মামলার রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়ে ১৭ নভেম্বর শেষ করে রায়ের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেন বিচারক। মামলাটিতে চার্জশিটভুক্ত ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেন ট্রাইব্যুনাল।
আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর গোলাম সারওয়ার খান (জাকির) আসামি সবার মৃত্যুদণ্ড হবে বলে আশা করছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, হলি আর্টিজানে হামলা মামলাটিতে আসামিরা দেশের সংহতি ও জননিরাপত্তা বিপন্ন করেছে। পরিকল্পিতভাবে কূটনৈতিক এলাকায় হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশিদের হত্যা করে তারা বহির্বিশ্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। ওই হামলায় ২২ জন ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
গোলাম সারওয়ার বলেন, মামলার আট আসামির মধ্যে ছয় জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিদের বাড়ির মালিক ও কেয়ারটেকাররা শনাক্ত করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দি ও আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি উভয় পক্ষকে সামর্থন করেছে। আসামিদের মধ্যে তাহরিম কাদেরী তাদের বাসায় কে কে যেত, সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীর মাধ্যমে আসামিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ, অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ প্রদানসহ জড়িত সবার তথ্য বের করে এনেছি। সে কারণে আমরা আদালতের কাছে বলেছি, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬ (২) উপধারায় ১-এর ধারা মতে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড পাওয়া উচিত।
এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, আসামিদের পক্ষের আইনজীবীরা যে অভিযোগ করেছেন, তা সঠিক নয়। আসামিদের স্বীকারোক্তি ও মামলার আলামত একে অন্যকে সমর্থন করে। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ১ জুলাই চার্জশিট দাখিল করেছেন। সেই প্রতিবেদনে আসামিদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ স্পষ্ট। সবকিছুই একে অন্যকে সমর্থন করে। তাই আসামিদের সর্বোচ্চ সাজাই হবে বলে আমরা আশা করছি।
অন্যদিকে, আসামি পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, মামলাটির যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে, এখন রায়ের অপেক্ষা। রাষ্ট্রপক্ষের ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য, আলামত, তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। মোট চার দিনের যুক্তিতর্কে আমরা সেই বিষয়গুলো আদালতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। রাষ্টপক্ষের তথ্যে গড়মিল রয়েছে, সে কথা তুলে ধরেছি। মামলার ছয় আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন, সেটা ছিল শেখানো কথা। আসামিরা সে কথা আদালতে নিজ মুখে বলেছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দাখিল করা চার্জশিট ও অন্যান্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যেও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তাই আমরা আশা করছি, আদালত ন্যায় বিচার করবেন।
২০১৮ সালের ১ জুলাই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পরিদর্শক হুমায়ূন কবির ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিম (সিএমএম) আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেন। এরপর ২৬ জুলাই সিএমএম আদালত মামলাটি ট্রাইব্যুনালে বদলির আদেশ দেন। চার্জশিটে ২১ জন আসামির নাম থাকলেও তাদের মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন সময় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে মারা যাওয়ায় তাদের অব্যাহতি দিয়ে অভিযুক্ত করা হয় আট জনকে। ওই বছরে গত ২৯ আগস্ট পলাতক আসামি মো. শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদের সম্পত্তি ক্রোক ও তাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেন আদালত।
মামলার আসামিরা হলেন— অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশ, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, মামুনুর রশিদ ও শরিফুল ইসলাম। আসামিরা সকলেই কারাগারে রয়েছে।
এদিকে, মামলাটির চার্জশিট দাখিলের সময় এ ঘটনায় আলোচিত ব্যক্তি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তার বিরুদ্ধে এই হামলায় জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলে পড়ে জঙ্গিরা। হামলায় রেস্টুরেন্টে খেতে আসা ইতালির ৯ জন, জাপানের সাত জন, ভারতীয় একজন ও বাংলাদেশি তিন নাগরিকসহ রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের মধ্যে দু’জন প্রাণ হারান। একই ঘটনায় জঙ্গিদের গ্রেনেডের আঘাতে রেস্তোরাঁর বাইরে মারা যান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান।
ঘটনাস্থলে তাণ্ডব চালানোর পর রাতভর রেস্তোরাঁয় আসা বাকি অতিথি ও রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের জিম্মি করে রাখে জঙ্গিরা। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর বিশেষ একটি কমান্ডো টিম পরিচালিত অপারেশন থান্ডার বোল্ট এর মাধ্যমে অভিযানের সমাপ্তি ঘটে।
হামলার সাত দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়। পাঁচ জঙ্গিসহ শেফ সাইফুল ইসলাম ও সহকারী শেফ শাওনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে দীর্ঘদিন পরে থাকার পর বেওয়ারিশ ঘোষণা করে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।