কর্ণফুলীতে ওয়াটার বাস: চালুর আগেই অনেক প্রশ্ন
২৬ নভেম্বর ২০১৯ ১০:২৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সড়কপথে যানজট এড়িয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানযাত্রীদের কম সময়ে পৌঁছে দিতে কর্ণফুলী নদীপথে চালু হতে যাচ্ছে ওয়াটার বাস। বিমানবন্দরমুখী সড়কে যানজট কমাতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষই এই যাত্রী পরিবহন সেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে চালুর আগেই ওয়াটার বাস প্রকল্প ঢাকার মতো ব্যর্থ হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ওয়াটার বাস ছাড়বে নগরীর সদরঘাটে চট্টগ্রাম বন্দরের নির্মিত টার্মিনাল থেকে। নগরীতে নিয়মিত যানজট হয়— এমন সড়কগুলোর মধ্যে সদরঘাটও আছে। ওয়াটার বাসের মাধ্যমে বিমানবন্দর সড়কের যানজট এড়ানো গেলেও সদরঘাট পর্যন্ত পৌঁছাতে যানজট কিভাবে এড়ানো যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে নৌপথের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে মাথপিছু ৪০০ টাকা। মাত্র ১৫ কিলোমিটার নৌপথ পাড়ি দেওয়ার জন্য ৪০০ টাকা ভাড়া অযৌক্তিক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া কোনো ধরনের সমীক্ষা ও বিশেষজ্ঞ মতামত ছাড়াই বন্দরের চ্যানেল ব্যবহার করে চলাচলকারী ওয়াটার বাসে যাত্রীদের নিরাপত্তার প্রশ্নও সামনে আসছে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানবন্দর সড়কে যে পরিমাণ যানজট হচ্ছে এবং দিনদিন তা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই ভোগান্তি এড়িয়ে বিমানের যাত্রীদের বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়াটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় ওয়াটার বাস চালুর উদ্যোগটা নিঃসন্দেহে আশার সঞ্চার করছে।’
‘কিন্তু সংকটটা হচ্ছে, কর্ণফুলী নদী বা চট্টগ্রামের জন্য সম্পূর্ণ নতুন এই সার্ভিস চালুর আগে যে ধরনের সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেটা হয়েছে বলে আমরা জানি না। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্ন চলে আসছে। কিছু একটা মাথায় আসল আর হুট করে চালু করে দিলাম, এটা আসলে টেকসই হয় না। ওয়াটার বাস ব্যর্থ প্রকল্প হবে, এটা আমি বলছি না। তবে ব্যবস্থাপনায় যদি ঘাটতি থাকে চট্টগ্রামের ওয়াটার বাসও ঢাকার পরিণতি ভোগ করবে,’— বলেন সুভাষ বড়ুয়া।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্বরত বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিমানবন্দরে প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত গড়ে ২৮টি বিমান আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করে। গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজারের মতো যাত্রী বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া করে। আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীদের সঙ্গে আত্মীয়স্বজন আসা-যাওয়া করে আরও কমপক্ষে দেড় হাজার। আর বিমানবন্দর সড়কে প্রতিদিন শুধু বিমানযাত্রী ও তাদের স্বজনদের নিয়ে চলাচল করে কমপক্ষে এক হাজার যানবাহন।
নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের হিসেবে, বিমানযাত্রী ও তাদের স্বজনদের যানবাহন ছাড়াও বিমানবন্দর সড়কে দৈনিক ৫ থেকে ৬ হাজার গাড়ি চলাচল করে। এর মধ্যে বন্দর, ইপিজেড, কারখানা, কনটেইনার ডিপোতে চলাচলকারী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইম মোভার, সরকারি-বেসরকারি অফিসের গাড়ি এবং সাধারণ গণপরিবহন আছে।
এই বিপুল সংখ্যক যানবাহনের চাপ সামলাতে পারছে না একমাত্র বিমানবন্দর সড়কটি। ফলে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মূল শহরে পৌঁছাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগছে। আবার মূল শহর কিংবা আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে পৌঁছাতে একই সময় যানজটে আটকা পড়ে থাকতে হচ্ছে। গত বর্ষার সময় জলাবদ্ধতার মধ্যে যানজটে আটকা পড়ে ফ্লাইট ধরতে না পেরে যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে উঠেছিল।
এ অবস্থায় বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ওয়াটার বাস চালুর উদ্যোগ নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড ও বেসরকারি এস এস ট্রেডিংকে সেগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাটে একটি টার্মিনাল ও পতেঙ্গায় একটি পন্টুন জেটি নির্মাণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। যাত্রী উঠানামার জন্য টার্মিনাল ও জেটি নির্দিষ্ট ভাড়ার ভিত্তিতে ব্যবহার করবে এস এস ট্রেডিং।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘টার্মিনাল ও জেটি ব্যবহার বাবদ ওয়াটার বাস পরিচালনকারী প্রতিষ্ঠান বছরে ৭০ লাখ টাকা বন্দরকে পরিশোধ করবে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর ২৫ শতাংশ হারে ভাড়া বাড়বে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমাদের এমন চুক্তি হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন দুইটি ওয়াটার বাস দিয়ে যাত্রী পরিবহন করা হবে। দিনে ১১ বার করে দু’টি বাস ২২ বার সদরঘাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত আসা-যাওয়া করবে। শীততাপ নিয়ন্ত্রত প্রতিটি বাসে যাত্রী ধারণক্ষমতা ২৫ জন। প্রতিটি বাসে লাগেজ বহন করা যাবে ২৫টি।
নগরীর সদরঘাট টার্মিনাল থেকে পতেঙ্গা জেটি পর্যন্ত নৌপথের দূরত্ব ৮ নটিক্যাল মাইল বা ১৫ কিলোমিটার। পরীক্ষামূলকভাবে এরই মধ্যে সেই পথে ওয়াটার বাস চালানো হয়েছে। এই দূরত্ব অতিক্রমে ওয়াটার বাসের সময় লেগেছে সর্বোচ্চ ১৮ মিনিট। পতেঙ্গা থেকে যাত্রীদের লাগেজসহ বহন করবে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাস। তারাই বিমানবন্দরে পৌঁছে দেবে। সব মিলিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা।
প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওয়াটার বাসের টার্মিনাল সদরঘাটে কেন করা হলো, এটি কালুরঘাট কিংবা শাহ আমানত সেতু এলাকায় করলে আরও বেশি সুফল পাওয়া যেত কি না— সেগুলো বিবেচনা করা দরকার ছিল। সদরঘাট এমনিতেই ব্যস্ততম এলাকা। শহরের বাসিন্দারা হয়ত যেকোনোভাবে সেখানে পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু দূরদূরান্ত থেকে যেসব যাত্রী ও তার আত্মীয়স্বজন আসবেন, তারা যদি সদরঘাট পৌঁছাতে আরেকদফা যানজটে পড়েন, তাহলে তো কথা একই হলো। এছাড়া জোয়ার-ভাটার সময় এই ওয়াটার বাস কিভাবে চলবে, বন্দর চ্যানেলে জাহাজ চলাচলে কোনো ঝুঁকি আছে কি না, এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাজ ছিল শুধু টার্মিনাল ও জেটি নির্মাণ করে দেওয়া। ঘাট সুবিধাটা শুধু আমরা দিচ্ছি। এর বাইরে সমীক্ষা করা হলো কি না, কী চালাবে আর কী চালাবে না, সেটা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দেখবে। আর আমাদের চ্যানেলে তো যাত্রী নিয়ে ছোট ছোট নৌকাও চলে। শিকলবাহা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেরিন একাডেমির স্পিডবোটও চলে। সুতরাং চ্যানেলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা আছে বলে আমরা মনে করছি না।’
ওয়াটার বাস পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান এস এস ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাবাব হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তিন বছর ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওয়াটার বাস সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা তো হুট করে এই প্রজেক্ট চালু করছি না।’
এদিকে মাথাপিছু ৪০০ টাকা ভাড়ার বিষয়টিও অযৌক্তিক বলছেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোকজন। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কলিম সরওয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওয়াটার বাস অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু জনপ্রতি ৪০০ টাকা ভাড়া অনেক বেশি। ফুয়েল কস্ট কত, এর সঙ্গে সামঞ্জস্য করে ভাড়া নির্ধারণ করা উচিত। মানুষের ভোগান্তি কমুক, একইসঙ্গে তাদের গলাও যেন কাটা না পড়ে, সেটা দেখতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গ্রামগঞ্জ থেকে আসা বিমানযাত্রীদের একেকজনের সঙ্গে ৪-৫ জন করে আত্মীয়স্বজন বিমানবন্দরে যান। গ্রাম থেকে গাড়ি ভাড়া করে সদরঘাট এসে আবার মাথাপিছু ৪০০ টাকা করে দিয়ে আরও ৪-৫ হাজার টাকা খরচ করে কেউ ওয়াটার বাস ব্যবহার করবে না। একেবারে নিয়মিত যারা ঢাকা-চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করেন, চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দা কিংবা ঢাকা থেকে কাজের সূত্রে আসা লোকজন ছাড়া কারও এই ওয়াটার বাস ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখছি না। সর্বস্তরের যাত্রীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে না পারলে ওয়াটার বাস টিকবে না। ঢাকার বুড়িগঙ্গায়ও ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু করা হয়েছিল, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ গুলশান থেকে রামপুরা পর্যন্ত একটা সার্ভিস আছে, ভাড়া মাত্র ১৫ টাকা। সেটা চালু আছে এবং খুব জনপ্রিয়।’
নাগরিক উদ্যোগের প্রধান উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানবন্দর সড়কের যানজট কমাতে ওয়াটার বাস চালুর দাবি আমরাই নাগরিক উদ্যোগের পক্ষ থেকে করেছিলাম। এখন এটা চালু হচ্ছে, খুবই খুশির বিষয়। আশা করি, এই সার্ভিস শুধু বিমানবন্দরের যাত্রীদের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত করা হবে। যেসব ট্যুরিস্ট স্পট আছে, সেখানেও ওয়াটার বাস চালু হোক। একবার চালু হয়ে গেলে ধীরে ধীরে এই ওয়াটার বাস গণপরিবহনে রূপ পাবে বলে আমার বিশ্বাস। আর বেশি ভাড়ার বিষয়ে যেসব প্রশ্ন আসছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আশা করি সেগুলো বিবেচনায় নেবে।’
ভাড়ার বিষয়ে এস এস ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাবাব হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওয়াটার বাস চলবে অকটেনে। ঘণ্টায় চলবে ৩০ নটিক্যাল মাইল বেগে। সর্বোচ্চ ২০ মিনিটের মধ্যে আমরা সদরঘাট থেকে পতেঙ্গায় পৌঁছে দেবো। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ওয়াটার বাসে আমরা আন্তর্জাতিক মানের সেবা দেবো। এছাড়া পতেঙ্গা থেকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও আমাদের। সব মিলিয়ে ৪০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে চালুর পর ভবিষ্যতে ভাড়া পুনঃনির্ধারণের বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় আছে।’
সাবাব জানান, প্রাথমিকভাবে দু’টি বাস দিয়ে চলবে এই সার্ভিস। জানুয়ারিতে আরও দুইটি বাস বহরে যুক্ত হবে। চলতি নভেম্বর মাসের মধ্যেই ওয়াটার বাস সার্ভিস উদ্বোধনের ইচ্ছা আছে তাদের। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ এর উদ্বোধন করবেন।