মোদির চিঠি-পীরের দোয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতার খোয়াব অলির
২৬ নভেম্বর ২০১৯ ২০:১০
ঢাকা: সেটি ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাঠানো একটি চিঠি। বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক নেতার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই সেই চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই চিঠিকেই ওই নেতা ধরে নিলেন বড় সহায় হিসেবে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার। দলের ও দলের বাইরের ঘনিষ্ঠদের ডাকলেন। কার কী মন্ত্রণালয় পছন্দ— সেটা পর্যন্ত জানতে চাইলেন!
ঘটনাগুলো ঘটেছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের ক্ষেত্রে। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে, চিঠিটি পাওয়ার পর ঠিক এমন সব আচরণই করছিলেন এই নেতা। এমনকি জামায়াতকে নিয়ে নতুন জোট করার পেছনেও রয়েছে সে ঘটনা।
সূত্রমতে, ২০১৮ সালে অলি আহমেদ বীর বিক্রম তার ৮০তম জন্মদিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে ওই শুভেচ্ছা বার্তা পান। প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশ ভারতের সরকারপ্রধানের কাছ থেকে ওই বার্তা পাওয়ার পর অলি আহমেদ বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বলেই জানাচ্ছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রটি।
ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলাপচারিতায় কর্নেল অলি নিজের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তার পেছনে নানা যুক্তিও তুলে ধরছিলেন। সূত্রমতে, তিনি বলছিলেন, ভারত সরকার হয়তো তাকে দিয়েই বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থার পট পরিবর্তন চায়।
ওই চিঠির সঙ্গে অলি আহমেদ মিলিয়ে নিয়েছিলেন তার অনেক আগে পাওয়া এক পীরের দোয়াকেও। সেই পীর তাকে বলেছিলেন, একদিন তার হাতেই যাবে রাষ্ট্রক্ষমতা। মৃত্যুর আগে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান একটা কিছু তিনি হবেনই, সেটাই ছিলো পীরের ভবিষ্যদ্বাণী— জানাচ্ছে এই নেতার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র।
সূত্রটি জানায়, সেই ভবিষ্যদ্বাণীতে প্রগাঢ় বিশ্বাস রেখেই পথ চলছেন দেশের রাজনীতির মাঠে সুপরিচিত নাম এই অলি আহমেদ, মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য রাষ্ট্র যাকে বীর বিক্রম উপাধি দেয়। পরে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মন্ত্রিত্বও পান তিনি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চার-দলীয় জোটের সরকারে যখন মন্ত্রিত্ব থেকে বঞ্চিত হলেন, তখন নিজেই দল গঠন করলেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) নামে। সেবার জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীকে খুশি করতে কর্নেল অলিকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন খালেদা জিয়া।
নিজের নির্বাচনি এলাকা চট্টগ্রামের চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম-১৪) থেকে বেশ কয়েকবার জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন এই অলি আহমেদ। একসময় বিএনপি-বিমুখ হয়ে দল গড়লেও পরে সেই বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গেই ফের হাত মেলান। হয়ে ওঠেন সে জোটের নীতি-নির্ধারকদেরও একজন। তবে ২০০৬ সালের পর সে জোট আর কখনোই ক্ষমতায় আসতে না পারায় হয়ে পড়েন জোটবিমুখও। ফলে একাই পথ চলছিলেন এলডিপির এই নেতা। কিন্তু তাতেও খুব একটা সফল হতে পারলেন না। খেতাবপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা একসময় জামায়াত-বিমুখ থাকলেও এখন সেই জামায়াতের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধতে চাইছেন, আর সে পথেই দেখছেন তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নেতা শেখ হাসিনা, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নেতা খালেদা জিয়া, গণফোরাম নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন। সুতরাং তাকেও একটা বিকল্প রাজনৈতিক জোট গঠন করতে হবে, যার নেতৃত্বে থাকবে এলডিপি এবং নেতা হবেন তিনি নিজে— এমন স্বপ্নের কথা অনেকের সঙ্গেই শেয়ার করেছেন অলি আহমেদ।
তবে জনসমর্থন বা সাংগঠনিক শক্তির জোরে নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাঠানো ওই চিঠি আর জনৈক পীরের দোয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতার খোয়াব দেখেন অলি আহমেদ বীর বিক্রম। আর সে কারণেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটকে পাশ কাটিয়ে বিকল্প জোট ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ গঠন করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মুক্তি মঞ্চ গঠেনের পেছনে রয়েছে অলি আহমেদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ২৭ জুন ওই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের ঘোষণার পর আগস্ট মাসের মধ্যেই জাতীয় মুক্তি মঞ্চের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের ‘অলীক স্বপ্ন’ ছড়িয়ে দেন অনুসারীদের মধ্যে। মন্ত্রিসভায় কে কে স্থান পাবে, তারও একটা খসড়া তৈরি করেন তিনি।
সূত্র জানায়, নিজের দল তো বটেই, বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন অলি। আহ্বান জানান বিএনপি ছেড়ে এলডিপি তথা ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চে’ যোগ দেওয়ার। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল এলডিপিতে যোগ দেন। জাতীয় মুক্তি মঞ্চের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে হাজির হন আওয়ামী লীগ ছেড়ে নির্বাচনের আগে বিএনপিতে যোগ দেওয়া গোলাম মওলা রনিও।
এছাড়া বিএনপির পাঁচ জন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন যুগ্ম মহাসচিব, একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রীসহ (একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত) অন্তত ৩০ জন শীর্ষ নেতাকে দল থেকে ভাগিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন অলি। এক্ষেত্রেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সেই চিঠি ও পীরের দেওয়া সেই দোয়া তার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে বলে জানায় সূত্র।
অবশ্য ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এগুলো ভিত্তিহীন বক্তব্য। আমি কেবল এলডিপিকে সংগঠিত করার কাজ করছি। আর খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি।’
জানা গেছে, জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠনের আগে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অলি আহমেদ। দেশটির ক্ষমতাসীন দলের মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার সঙ্গে ঢাকা, ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুরে বৈঠকও করেন তিনি। সূত্র জানায়, তারা তাকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেন যে বিএনপি থেকে ৬০/৭০ জন নেতাকে বের করে আনতে পারলে সব ধরনের সহযোগিতা মিলবে তাদের পক্ষ থেকে।
সূত্র আরও জানায়, কর্নেল অলির এই উদ্যোগের বিষয়টি জানতে পেরে বিএনপির তরফ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিএনপির কাউকেই তখন পাত্তা দেননি তিনি। উপায়ান্তর না দেখে বিএনপির হাইকমান্ড নিজের দলের লোকদের কর্নেল অলির মঞ্চে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। হাইকমান্ডের অনুরোধে অবশ্য কাজ হয়, ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল আর গোলাম মওলা রনি ছাড়া আর কেউ যাননি অলির মঞ্চে। পরে বিএনপির শীর্ষ নেতার ফোন পেয়ে অলির মঞ্চ থেকে নেমে আসেন রনিও।
পীরের দোয়ার বিষয়টিতে বিস্তারিত খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, মুলালীর পীর নাতে খ্যাত এক ব্যক্তি অলি আহমেদ সম্পর্কে এই মর্মে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অদূর ভবিষ্যতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হবেন। সুতরাং আগস্টের মধ্যে সরকার গঠনের যে স্বপ্ন অলি আহমেদ দেখেছিলেন, সেখানে ব্যক্তিগত পীরের ভবিষদ্বাণীর বিষয়টিও কাজ করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম সারাবাংলাকে বলেন, ‘জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদি আমাকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং আমার একজন পীরও ছিলেন। কিন্তু মোদির চিঠি ও পীরের দোয়ায় আমি রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চাই— এমন কথা আমি কখনো কাউকে বলিনি। তাছাড়া আমার পীর ১৯৯৮ সালে ইন্তেকাল করেছেন। একজন মৃত ব্যক্তির বিষয়টি এভাবে টেনে আনা ঠিক নয়।’
এলডিপি কর্নেল অলি আহমেদ জাতীয় মুক্তি মঞ্চ নরেন্দ্র মোদির চিঠি পীরের দোয়া রাজনৈতিক জোট রাষ্ট্রক্ষমতার স্বপ্ন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)