মহানগরে মহাবিরক্ত শেখ হাসিনা, আসছে নতুন কমিটি
২৮ নভেম্বর ২০১৯ ১০:৫০
ঢাকা: আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের প্রচলিত রেওয়াজ হলো- জাতীয় সম্মেলনের আগে সব সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন শেষ করা। এরই মধ্যে দলটির সহযোগী সংগঠনগুলোর জাতীয় সম্মেলন শেষ হয়েছে। এবার পালা মূল দলের সম্মেলন। আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তবে তার আগে আসছে ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সম্মেলন। এরই মধ্যে সম্মেলনকে ঘিরে চলছে নানা আলোচনা। আর আলোচনার কেন্দ্রে একটা প্রশ্নই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটি হলো- মহানগর আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতৃত্ব যাচ্ছে কার কার হাতে?
তবে এটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর এবং দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের চার পদ থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছেন বর্তমান কমিটির শীর্ষ চার নেতা। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কর্মীবান্ধব ত্যাগী নেতারাই পেতে যাচ্ছেন ওই পদগুলো। আওয়ামী রাজনীতির রাজপথের হৃৎপিণ্ড বলে খ্যাত ঢাকা মহানগরের শীর্ষ নেতাদের ওপর মহাবিরক্ত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ জন্য তিনি ৩০ নভেম্বরের সম্মেলনে নতুন মুখ উপহার দিতে যাচ্ছেন বলে দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতারা সারাবাংলাকে জানান, চলতি মাসে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সম্মেলনেই পুরনোরা বাদ পড়েছেন। মহানগরের বিতর্কিত নেতাদের জন্য এটাই বড় বার্তা। কারণ, নেত্রী বিভিন্ন মাধ্যমে সবার আমলনামা সংগ্রহ করেছেন। যাদের নামে কমিটি বাণিজ্য এবং দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে, এমনকি পদ পাওয়ার যারা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন তারাও বাদ পড়বেন মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ও সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব) মুহম্মদ ফারুক খানকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন।
আগামী ৩০ নভেম্বর সকাল ১১টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী লে.কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘আমাদের এরই মধ্যে সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনের মাধ্যমে একটা বার্তা দিয়েছেন। তাই ৩০ তারিখের সম্মেলনেও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে প্রবীণ ও নবীনের সমন্বয়ে কমিটি গঠন হবে।’
দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের শীর্ষ চার পদেই নতুন মুখ আসছে। এ ক্ষেত্রে উত্তরের সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহ এবং দক্ষিণের সভাপতি আবুল হাসনাত বয়সজনিত কারণে বাদ পড়তে পারেন। অন্যদিকে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান এবং শাহে আলম মুরাদও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণের বাদ পড়তে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে বেশ কয়েকজনের আমলনামা দলীয় সভাপতির কাছে জমা পড়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণে সভাপতি পদে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য কাজী নজিবুল্লাহ হিরু, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের (ডিএসসিসি) ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু আহমেদ মান্নাফি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, ঢাকা-৭ ডিএসসিসির ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি হুমায়ুন কবির এবং যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোয়ার হোসেন মনু। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামও সভাপতি পদের জন্য আলোচনায় আছেন বলে জানা গেছে।
তবে সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. কাজী মোর্শেদ হোসেন কামালের নামও আলোচনায় রয়েছে। তিনি সাবেক বৃহত্তর ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ডিএসসিসির ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওমর বিন আজিজ ওরফে তামিম আজিজ সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজের পুত্র।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, ‘আসন্ন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের প্রস্তুতির কোনো কমতি নেই। নেত্রী বলেছিলেন, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও সৎ মেধাবীদের সামনে নিয়ে আসার জন্য। সে অনুযায়ী চারটা সম্মেলনে তার চাওয়ার প্রতিফলন ঘটেছে। সেজন্যই আমরা আশাবাদী, নগর আওয়ামী লীগেও পোড় খাওয়া সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বকে আপা (শেখ হাসিনা) সামনে নিয়ে আসবেন।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি হুমায়ুন কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সভানেত্রী যেহেতু অনেক ভেবেচিন্তে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। স্বাভাবিকভাবে নেত্রীর একটা ডিটারমেনিশন আছে কমিটিতে ভাল সৎ যোগ্য জনপ্রিয় অভিজ্ঞ নেতৃত্ব উপহার দেবেন।’
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসএ মান্নান কচি বলেন, ‘নেত্রী যাকে যোগ্য মনে করবেন, তার হাতেই সংগঠনের নেতৃত্ব তুলে দেবেন। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, আমরা তা মেনে নিতে প্রস্তুত আছি।’
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের দফতর সম্পাদক এম. সাইফুল্লাহ সাইফুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। যেহেতু আমি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম, সেহেতু আমি পজেটিভ। মহানগরের দফতর সম্পাদক হিসেবে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে আমি আশাবাদী। আমি জোর গলায় বলতে পারি, কোন টেন্ডারবাজি ও জমি দখলে কোনো কালেই সম্পৃক্ত ছিলাম না।’
এদিকে আসন্ন সম্মেলনে উত্তরের সভাপতি পদে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান কমিটির সহসভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কাদের খান। তারা দুজনেই সভাপতি পদ প্রত্যাশী। এছাড়াও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান কমিটির সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এসএ মান্নান কচি। তিনি অবিভক্ত ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান কমিটির দফতর সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ উত্তরের সাবেক সভাপতি এম. সাইফুল্লাহ সাইফুল। এর বাইরেও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আবুল বাশারও মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরে প্রার্থী হিসাবে আলোচনায় রয়েছেন।
দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, মহানগরের কমিটির ঘোষণার পর উত্তর ও দক্ষিণের বিভিন্ন থানা ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া শুরু করে মহানগরের শীর্ষ নেতারা। এছাড়াও সম্প্রতি ক্যাসিনো বাণিজ্য, বিএনপি-জামায়াত দলীয় পরিবার থেকে কমিটিতে স্থান দেওয়াসহ সরকারি ও সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখলসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন কমিটির কয়েকজন নেতা। যা নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডে অভিযোগ যায়। খোদ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বিভিন্ন বর্ধিত ও আলোচনায় সভায় এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মহানগর নেতাদের সতর্ক করেন।কিন্তু কোন অদৃশ্য কারণে মহানগরের শীর্ষ নেতারা কর্ণপাত করেননি। এমনকি থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়নগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। কয়েকটি থানায় কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নিলেও সেখানে বিএনপি-জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টির লোকদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ ওঠে দলের ভিতরে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছেও দ্বারস্থ হন বর্তমান কমিটি কয়েকজন নেতা। এমন একটি অভিযোগের অনুলিপি সারাবাংলার কাছে এসেছে।
২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী সভাপতি হিসাবে বিএনপি-জামায়াতের হোতা আব্দুর রহমান বাবলাকে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে জামাতের টাকায় সে এই পদ পেয়েছে। চিঠির অনুলিপিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, লালবাগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ দুর্নীতি দমন কমিশনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদর দফতর ও গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান বরাবর পাঠানো হয়েছে।
একারণে চলতি মাসে, গণভবনে আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতা দলের সভাপতির সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে বিভিন্ন আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘এরা তো ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগটাকেই শেষ করে দিয়েছে। এদের কত টাকা দরকার। আর না, দ্রুত সম্মেলন করতে হবে।’
এর পর গত ৫ নভেম্বর রাতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা গণভবনে সাক্ষাৎ করতে গেলে শেখ হাসিনা উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলন আগামী ৩০ নভেম্বর আয়োজনের নির্দেশ দেন। এর আগে, ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের দীর্ঘদিন পরও কমিটি দিতে না পারায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাককে দক্ষিণ এবং কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে উত্তরের কমিটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরে সম্মেলনের সাড়ে তিন বছরের মাথায় ২০১৬ সালে ১০ এপ্রিল প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মহানগর উত্তরে এ কে এম রহমত উল্লাহকে সভাপতি ও সাদেক খানকে সাধারণ সম্পাদক এবং দক্ষিণে আবুল হাসনাতকে সভাপতি ও মো. শাহে আলম মুরাদকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকার দুই অংশে কমিটি দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ভেঙে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুটি কমিটি হয়। একইসঙ্গে ঢাকা মহানগরের ৪৯টি থানা ও ১০৩টি ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নামও ঘোষণা করা হয়। তিন বছর মেয়াদী মহানগর আওয়ামী লীগের দুই অংশের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এবার দেখার পালা কে কে আসছেন মহানগরের নতুন নেতৃত্বে।