Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রথম ১০ দিনে ৬২ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৭৩, মামলা পুরনো আইনেই


২৯ নভেম্বর ২০১৯ ১৩:৫৯

ঢাকা: প্রয়োগে শিথিলতা এনে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও কার্যত পুরনো আইনেই চলছে গণপরিবহন খাতের কার্যক্রম। সড়ক দুর্ঘটনার মামলা দেওয়া হচ্ছে পেনাল কোডে। ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা হচ্ছে আগের আইনে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, নতুন আইনে মামলা দেওয়ার নির্দেশ না আসায় পুরনো আইনেই আপাতত মামলা নিচ্ছেন তারা। আর নতুন আর বাস্তবায়ন থেকে সরে আসাকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিন অনুসন্ধান ও বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ নভেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ১০ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭৩ জন নিহত হয়েছেন, আহত শতাধিক। শুধুমাত্র ১৫ নভেম্বরই ৮ স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর সড়কে। স্বাধীন পরিবহনের বাসচালক বেপোরোয়া গতিতে গাড়ি চালালে একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে ঘটনাস্থলে ৯ জন নিহত হন।

কিন্তু ওই ঘটনায় নতুন সড়ক আইনে মামলা হয়নি। পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন খান বাদী হয়ে শ্রীনগর থানায় যে মামলা দায়ের করেছেন, তা ১৮৬০ এর পেনাল কোডের (দণ্ডবিধি) ২৭৯/৩৩৭/৩৩৮-ক/৩০৪- খ ধারায়। এই ধারায় মামলা জামিনযোগ্য এবং সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আর এ মামলা যদি নতুন সড়ক পরিবহনে হতো, তাহলে এ ধরনের অপরাধে আইনের ১০৫ অনুযায়ী শাস্তি হতো সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।

নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হওয়ার পরে ঘটে যাওয়া এ দুর্ঘটনার মামলা কেন পুরনো পেনাল কোডে দেওয়া হলো, এ প্রশ্নের জবাব জানতে শ্রীনগর থানার ওসি মো. হেদায়াতুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নতুন আইনে মামলা নেওয়ার নির্দেশ না পাওয়ায় পুরনো আইনেই মামলা করা হয়েছে। তবে নতুন আইনের অনুমতি এলে সে অনুযায়ী চার্জশিট দাখিলের কথা জানান তিনি।

বিজ্ঞাপন

একইভাবে রাজধানীর বনশ্রীতে কাভার্ড ভ্যানের  ধাক্কায় এক নারীর মৃত্যুর ঘটনা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে। তা পুরনো আইনে হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

রাজধানীর কয়েকটি থানায় এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাও জানিয়েছেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন এখনো পুরোপুরি কার্যকরের নির্দেশ তারা পাননি। এ কারনেই পুরনো আইন অনুসরণ করছেন তারা।

অন্যদিকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ধরতে বিআরটিএ যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে, তাও পুরনো আইনেই।

সূত্র জানিয়েছে,  সড়ক পরিবহন আইন পাস হওয়ার প্রায় দেড় বছরের মাথায় এসে গেল ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার পরবর্তী ১৪ দিন চলে শুধু জনসচেতনতা বাড়াতে। এমন তথ্যই সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই সময়ের মধ্যে সড়ক পরিবহন আইন ভ্রাম্যমাণ আদালতের তফসিলভুক্ত হয়নি। ১৭ নভেম্বর তফসিলভুক্ত করে ১৮ নভেম্বর থেকে কার্যক্রম শুরুর দিন কয়েকটি গাড়ি ডাম্পিং এবং কিছুগাড়ির কাগজপত্র জব্দসহ অন্যান্য ত্রুটি পেয়ে প্রায় ৯০টি মামলা দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানা করা হয় ১ লাখ ২২ হাজার টাকা। এরপর পরিবহন চালক শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে এ কার্যক্রমের পরপরই ভ্রাম্যমাণ আদালতে শিথিলতার নির্দেশ আসে। আর এতে করে সড়কে পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্য ছিল, তা বহাল হয়ে যায় আগের মতোই। যদিও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা বলছেন সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগ হচ্ছে তবে তা শিথিল করে।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, লাইসেন্স সংক্রান্ত জটিলতার কারণেই নতুন আইনটি প্রয়োগ করা যায়নি। তবে এবার সেসব অসঙ্গতি দূর করেই মাঠে নামবেন। পাশাপাশি বিআরটিএকে শক্তিশালী করার কথা বলেন। আর এসব কাজ করতে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স ও গঠিত কমিটি কাজ করবে বলে জানান তিনি।

এদিকে এ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জোরেসোরেই বললেন, সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন থেকে পিছু হটেননি। শুধু প্রয়োগে শিথিল করা হয়েছে। যদিও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

আর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা বলছেন, পরিবহন মালিক, শ্রমিকদের হুমকিতেই সরকার আইন প্রয়োগ থেকে সরে এসেছে। গেল কয়েকদিনের সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, সরকারকে সব সময়ই তারা বাধ্য করতে পারে, ফলে চালকদের বেপোরোয়া মনোভাব কখনোই পরিবর্তন হয় না। এর প্রমাণ গত কয়েকদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি।

তিনি বলেন, ‘এ আইন প্রয়োগ করতে না পারলে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠবেন। যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।’

সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে কথা হয় পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় হয়েছে আইনি জাতীয় সংসদে পাস হয়। এই এক বছরে সরকারের উচিত ছিল পরিবহন খাতের জটিলতা দূর করা। কারণ, সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা জানেন এ ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ন আইন পরিবহন খাতে প্রয়োগ করতে গেলে কী ধরনের প্রস্তুতির দরকার। সেখানে হাত গুটিয়ে হঠাৎ করে প্রয়োগে নেমে গেলে তা কখনোই সফল ভাবে করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ‘প্রায় ২২ হাজার কাভার্ড ভ্যান দেশের সড়ক মহাসড়কে চলাচল করে, যার কোনোটিরই লাইসেন্স নেই। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ সরকারই করার সুযোগ করে দিয়েছে, এখন যারা ওই ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন, তারা তো লোকসানে যেতে চাইবেন না। তাই সরকারের উচিত ছিলো, গোড়ায় যেসব গলদ করে এসেছে আগে থেকে তা শুধরে বা শুধরানোর সুযোগ দিয়ে তারপর আইনের প্রয়োগে যাওয়া।’

এ প্রসঙ্গে কলামিস্ট আবুল মকসুদ বলেন, আইন প্রণয়নের সঙ্গে পরিবহন মালিক শ্রমিকেরা যুক্ত ছিলেন। যখন আইনটি তৈরি করা হয়, তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এখন তারাই রাস্তায় নেমে চালক শ্রমিকদের উস্কানি দিচ্ছে। এই দ্বিমুখী আচরণ কখনোই সড়কে শৃঙ্খলা নিয়ে আসবে না। সরকার যত ভালো আইন করুক না কেন পরিবহন নেতাদের সঙ্গে আগে বোঝাপড়া করেই মাঠে নামতে হবে, না হলে কখনোই তারা সড়ক নিরাপদ হতে দেবে না।

গত কয়েকদিনে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্যে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ণ, তার উল্টোটি হয়েছে। সড়কে সেই বিশৃঙ্খলা রয়েই গেল।

আরও পড়ুন-

পরিবহন ধর্মঘট স্থগিত

আমরা ধর্মঘট-অবরোধ ডাকিনি: শাজাহান খান

১ নভেম্বর থেকে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর

৩০ জুন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি নয়: পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন

আইনে সংস্কার দাবি পুরনো আইনে মামলা সড়ক পরিবহন সড়ক পরিবহন আইন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর