এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: ‘গ্রামে নেটওয়ার্ক খুবই দুর্বল। কথা বলতে বলতে প্রায়ই কল কেটে যায়। ঘরে নেটওয়ার্কই থাকে না! তাই প্রয়োজনীয় কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফাঁকা স্থানকেই বেছে নিই।’ —কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মাইজবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা আবিদ হাসান। মোবাইলফোন ব্যবহারে আবিদের মতো ওই গ্রামের সবার অভিজ্ঞতাই প্রায় এক। এমনকি দেশের অধিকাংশ গ্রামেও অভিজ্ঞতা প্রায় অভিন্ন।
শহরেও অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখের নয়। উঁচু তলার ভবনগুলোতে নেটওয়ার্ক সমস্যা পুরনো। নিচের ফ্লোরেও নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না ঠিকমতো। কলড্রপের ঘটনা অহরহ। খোদ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর কথোপকথনে ৮ বার কলড্রপের ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। বহুল কাঙ্ক্ষিত ফোর-জির নিলাম অনুষ্ঠানে বিরক্তির সুরেই তিনি বলেছিলেন তা।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি চার মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে বহুল কাঙ্ক্ষিত ফোর-জির লাইসেন্স হস্তান্তর করবে বাংলাদেশ টেলিযোগযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। আর সেদিন থেকেই দেশে চালু হতে যাচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের এই মোবাইল প্রযুক্তি। মোবাইল ফোন অপারেটগুলো বলছে, ফোর্থ অব ব্রডব্যান্ড সেলুলার নেটওয়ার্ক (ফোর-জি) সেবা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশ উঠে যাবে ‘ইন্টারনেট এক্সপ্রেসওয়েতে’। এতে, দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হতে পারে ইন্টারনেটের গতি। ফলে অনলাইনভিত্তিক যেকোনো সেবা প্রাপ্তি হয়ে উঠবে আরও সহজ। কোনো ফাইল ডাউনলোড বা আপলোডে সময় নেমে আসবে আগের চেয়ে অর্ধেকে। আমূল পরিবর্তন ঘটবে জীবনযাত্রাতেও। অধিকাংশ কাজ-কর্মই হয়ে উঠবে আরও বেশি নেটভিত্তিক।
তবে গ্রাহক পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, সেবাপ্রাপ্তিতে ফোর-জি নিয়েও তারা প্রতারণার আশঙ্কা করছেন। নগরীর বাসিন্দা আশিক মাহমুদ তাদের একজন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় এখনো ঠিকভাবে থ্রি-জি সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। ইন্টারনেট ব্যবহারে দেখা যায়— এই থ্রি-জি, মুহূর্তেই আবার টু-জি! নেটওয়ার্ক সমস্যাতো আছেই।’
ফোর-জিতে ইন্টারনেটের খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে আশিকের মধ্যে রয়েছে উৎকণ্ঠা। তার ভাষ্য, ‘আগে দেখা যেত ২ বা ৩ জিবি নেট নেওয়া হলে এক মাস চলে যেত, ফোর-জি আসার পর হয়তো ১৫ দিনেই তা শেষ হয়ে যাবে। এতে অনেকেই প্রথম পর্যায়ে প্রতারিত হবেন।’
তার মতে, ‘ফোর- জি’তে সিম পরিবর্তনে নতুন করে যে টাকা নেওয়া হচ্ছে তা গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণারই একটি অংশ। আর ফোর-জিতে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত সেবা চায় ওবায়েদুল ইসলাম রাব্বী। ফ্রিল্যান্সিংয়ের সবচেয়ে উন্নত ধাপ অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত এই তরুণ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাই সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত সেবা। আমাদের চাওয়া- ইন্টারনেট সংযোগ হোক নিরবচ্ছিন্ন। তবে দুর্ভাগ্য যে এখনও থ্রি-জি সেবাই ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী তো নিজেই বলে দিয়েছেন, অফিস থেকে বাসা পর্যন্ত যেতে ৮ বার কল ড্রপ হয়। এতেই স্পষ্ট আমাদের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা কতটা দুর্বল।’
গফরগাঁওয়ের বাসিন্দা আবিদ হাসানের মতে, ফোর-জি চালু হলে গ্রামের মানুষ হয়তো থ্রি-জি সেবার আওতায় আসতে পারেন। তবে ফ্রিল্যান্সাররা সরাসরি ফোর-জি ব্যবহারের উপকারভোগী হবেন না বলে জানিয়েছেন ফ্রিল্যান্সার জহিরুল ইসলাম রকি।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিং কাজে সাধারণত আমরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করি। মোবাইল নেট খুব দুর্বল হওয়ায় প্রায় সব ফ্রিল্যান্সারই ব্রডব্যান্ডে যুক্ত। তাই ফোর-জি এলেও খরচ না কমালে ফ্রিল্যান্সাররা সরাসররি এর তেমন কোনো সুফল পাবে না।’
মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো আচরণ করছে- এমন অভিযোগ এনে বাংলাদেশ মোবাইলফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ে ফোর-জি সেবা পেতে কমপক্ষে আরও ৩ বছর সময় লাগবে।’
তার মতে, ‘বর্তমানে ঢাকায় যে সেবা পাওয়া যাচ্ছে পঞ্চগড় বা ঠাকুররগাঁওয়ে সেই সেবা পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘রবি তো একই তরঙ্গে আছে তারা কিভাবে ফোর-জি সেবা দেবে? একই তরঙ্গে তারা তো থ্রি-জি সেবাও ঠিকমতো দিতে পারেনি।’
বিটিআরসির কাছে ইন্টারনেট ও কল ড্রপের পরিমাণ নিরূপণের যন্ত্র নেই এমন অভিযোগ করে মহিউদ্দীন আহমেদ আরও বলেন, ‘দেশে ইন্টারনেটের গতি ৫ এমবিপিএস বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে মোবাইল ইন্টারনেটে তা আরও অনেক কম। ২ থেকে ৩ এমবিপিএস হতে পারে। বিটিআরসির কাছে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি মাপার যন্ত্র কিন্তু নেই। কল ড্রপ কত হয় তা মাপার যন্ত্রও নেই। বিটিআরসি একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’
গ্রাহকের অধিকার নিয়ে কাজ করা মোবাইল ফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরও বলেন, ‘দুটি কোম্পানি তরঙ্গ কিনলো, তরঙ্গ ব্যবহার করা হয় বিটিএস (টাওয়ার) দিয়ে, কিন্তু টাওয়ার ব্যবস্থাই তো উন্নত নয়। সেবা দিতে হলে আগে টাওয়ার ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। তারা সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি জমা দিচ্ছে, এই টাকা তো আমাদের কাছ থেকে লোটপাট করা। প্রযুক্তির কথা বলে তারা আমাদের সাথে প্রতারণা করছে, লুটপাট করছে।’
সিম পরিবর্তনে লাগছে অর্থ: কয়েকটি কাস্টমার সেন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফোর-জিতে সিম পরিবর্তনে গ্রামীণফোন ১১০ টাকা করে নিচ্ছে। তবে জিপি স্টার গ্রাহকদের ক্ষেত্রে তারা কোনো টাকা নিচ্ছে না। জিপির কয়েকটি কাস্টমার কেয়ারে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিনিধিরা জানেন না ঠিক কবে ফোর-জি চালু হচ্ছে। তবে ফোর-জিতে সিম পরিবর্তনই এখন হয়ে উঠেছে তাদের মূল কাজ। কয়েকজন প্রতিনিধির মতে, ফোর-জি চালু হতে দুই থেকে সময়ও লাগতে পারে। সিম পরিবর্তন ছাড়া উপর থেকে তাদের এ বিষয়ে আর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
রবি সূত্রে জানা গেছে, তাদের সিম পরিবর্তনেও ১০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। তবে রবির ধন্যবাদ প্রোগ্রামের আওতায় থাকা প্লাটিনাম ও প্লাটিনাম এইচ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে সিম পরিবর্তনে বাড়তি কোনো অর্থের প্রয়োজন পড়ছে না। তবে, সিম পরিবর্তনে বাংলালিংক গ্রাহকদের বাড়তি কোনো অর্থ গুনতে হবে না। আর টেলিকটের প্রায় ৯০ ভাগ সিমই এখন ফোর জি। তবে ১০ ভাগ সিম পরিবর্তনে টাকা লাগবে কিনা তা এখনো জানায়নি তারা। সারাবাংলার পক্ষ থেকে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবিকে গ্রাহক হয়রানি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মেইল করা হলেও এখনো তার উত্তর দেয়নি কোম্পানিগুলো।
১৯ ফেব্রুয়ারি চালু হচ্ছে ফোর-জি: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রে জানা গেছে, ২০ ফেব্রুয়ারি ফোর-জির চূড়ান্ত লাইসেন্স দেওয়ার কথা থাকলেও একদিন এগিয়ে তা ১৯ তারিখেই দেওয়া হচ্ছে। আর লাইসেন্স দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অপারেটরগুলো চালু করতে পারবে ফোর-জি। তবে সব গ্রাহকই ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ফোর জি সেবা পাবে না। সেবা পেতে চাইলে গ্রাহককে প্রথমত পরিবর্তন করতে হবে বর্তমানের সিম কার্ড। এ ছাড়া গতি সম্পন্ন এই সেবা দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতেও প্রয়োজন পড়বে বেশ কিছুটা সময়ের। অপারেটগুলো নিজেদেরকে পুরো প্রস্তুত করা শেষে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলেই চালু হবে বহুল কাঙিক্ষত ফোর-জি। তবে বিটিআরসি’র দাবি, ফোর-জি চালুর জন্যে দেশ এখন পুরোপুরি পস্তুত।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯ ফেব্রুয়ারি অপারেটগুলোর মধ্যে লাইসেন্স হস্তান্তর করা হবে। সেদিন থেকেই চালু হচ্ছে ফোর-জি। অপারেটগুলো কিন্তু বহু আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যারা সিম কার্ড চেঞ্জ করে ফোর জিতে গিয়েছে তারা সেদিন থেকেই সেবা পাবেন।’ নেটওয়ার্ক সমস্যাজনিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তিগত সমস্যা থাকবে। ফোর-জি আসার পরও সমস্যা থাকতে পারে, তবে তা আগের চেয়ে কিছুটা কমবে বলে আশা করি।’
নিলামে দেশের আয় সোয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকা: গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে বহুকাঙি্ক্ষত ফোর-জির নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। ওই নিলামে অংশ নিয়ে বাংলালিংক ১০.৬ মেগাহার্জ ও গ্রামীণফোন ৫ মেগাহার্জ তরঙ্গ কেনে। দুটি কোম্পানির কেনা এই তরঙ্গ থেকে ভ্যাটসহ সরকারের কোষাগারে জমা পড়েছে প্রায় ৫২৬৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ফোর-জি তরঙ্গ বরাদ্দ পেতে চারটি অপারেটর আবেদন করলেও শেষ পর্যন্ত গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকই ওই নিলামে অংশ নেয়। তখন পর্যন্ত রবির হাতে সবচেয়ে বেশি তরঙ্গ থাকার অজুহাতে তারা নতুন করে নিলামে অংশ নেয়নি। আর ওই নিলামে তরঙ্গের বড় অংশটিই অবিক্রিত থেকে যায়। এতে মাত্র ৩৩ শতাংশ তরঙ্গের বিক্রি হয়েছিল, আর নিলামে উঠানো ৬৭ শতাংশ তরঙ্গই অবিক্রিত থেকে যায়। অভিযোগ রয়েছে, মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহক অনুযায়ী তরঙ্গ কিনছে না। অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশে বর্তমানেও তরঙ্গ বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম।
ওই নিলামে বিটিআরসির পক্ষে বলা হয়, নিলামের পর বর্তমানে গ্রামীণের হাতে তরঙ্গ আছে ৩৭ মেগার্হাজ, রবি ৩৬.৪ মেগার্হাজ, বাংলালিংক ৩০.৬ ও টেলিটক ২৫.২। গ্রাহক সংখ্যার ভিত্তিতে তাদের মার্কেট শেয়ার যথাক্রমে গ্রামীণ ৪৫.০২ শতাংশ, রবি ২৯.৫৭, বাংলালিংক ২২.৩২ এবং একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিটকের শেয়ার মাত্র ৩.১ শতাংশ।
ফোর জি-র সুবিধা: ইন্টারনেটের গতি হবে দ্বিগুণের চেয়ও বেশি। ফলে ডাউনলোড বা আপলোডে সময় লাগবে আগের চেয়েও অর্ধেক। ফোর আসার পর ডাটা ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ভয়েস কলেও অগ্রগতি ঘটবে। দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে ফোর জিতে ইন্টারেনটের গতি হতে পারে ৭ থেকে ১০ এমবিপিএস। বর্তমানে যা থ্রি-জিতে ৩ থেকে ৪ এমবিপিএসের মধ্যে রয়েছে।
সামগ্রিক প্রসঙ্গে ডাক টেলিযোযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফোর-জি এমন একটা প্রযুক্তি যা ডেটা সার্ভিসকে ভালো করবে। বিদ্যমান যে সমস্যা আছে তা দূর করার জন্যই কিন্তু আমরা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করছি। সারা দুনিয়া যা গুরুত্ব দিচ্ছে আমাদেরকেও সেদিকে যেদিকে যেতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘যেসব অভিযোগ আছে সেসব অভিযোগের জন্য আমরা খুব স্পষ্ট করে বলেছি টেলিকম অপারেটগুলোকে নজর দিতে হবে। তাদের একটা অভিযোগ ছিল তারা নেট সুবিধা পায় না। তাই তারা সেবা দিতে পারছে না। তারা বলত আমাদের যে পরিমাণ গ্রাহক আছে সে পরিমাণ তরঙ্গ নেই। এবার আমরা তরঙ্গ দিয়েছি। আমরা প্রত্যাশা করি— তরঙ্গের সক্ষমতা বাড়ায় জনগণের দুর্ভোগ কমবে।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/আইজেকে