‘এখনো স্কুল ছুটির সময় হলেই মনে হয় অরিত্রী এলো বুঝি!’
৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৮:২৮
ঢাকা: ‘প্রতিদিন স্কুল ছুটির সময় হলে মনটা ছটফট করে ওঠে, এই বুঝি মামনি আসছে। এই বুঝি অরিত্রী এসে ঘরে ঢুকবে। কিন্তু সে তো আর কোনোদিনই ঘরে আসবে না। সারাবছর ওর আত্মার শান্তির জন্য উপোস করি। মন্দিরে যাই। মায়ের শূন্য বুক শূন্যই থেকে যায়। আর কোনো মায়ের বুক যেন এরকমভাবে শূন্য না হতে হয়— সেই প্রার্থনাই করি সবসময়।’
অনেক কষ্টে কান্না সামলে কথাগুলো বলছিলেন বিউটি অধিকারী। ভিকারুননিসা নূর স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রয়াত শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর মা তিনি। একবছর আগের ঠিক এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমায় অরিত্রী। পরীক্ষা চলাকালে তার কাছে মোবাইল পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার মা-বাবাকে স্কুলে তলব করা হয়েছিল। মা-বাবা স্কুলে গেলে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কাছে রূঢ় আচরণের শিকার হয়েছিলেন। তা মেনে নিতে না পেরেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল অরিত্রী।
আরও পড়ুন- ‘হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার পরও অরিত্রীকে পরীক্ষায় দিতে দেয়নি’
একবছর পেরিয়ে গেলেও অরিত্রীর স্মৃতি যেন এখনো তাজা তার পরিবারের সদস্যদের কাছে। বিউটি অধিকারীর মতো অরিত্রীর বাবা ও বোনের কাছেও তাই মনে হয়, এই বুঝি অরিত্রী বসে আছে তার ঘরে। কিন্তু সে ভ্রম ভাঙতেও সময় লাগে না। সে কারণেই এখনো দিনে-রাতে অরিত্রীর স্মৃতিময়তায় কেবল কান্নাই সম্বল তাদের।
মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে শান্তিনগরে অরিত্রীদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তার ঘরটি আগের মতোই পড়ে আছে। যেখানে যা কিছু ছিল, একবছর পরও সেগুলো রয়েছে ঠিক সেভাবেই। অরিত্রীর বিছানা, বিছানার চাদর, বালিশ, পড়ার টেবিল, চেয়ার, গিটার, জানালার পর্দা— সবকিছুই রাখা হয়েছে পরমযত্নে। নেই শুধু অরিত্রীই।
কথা হয় অরিত্রীর মা, বাবা ও বোনের সঙ্গে। তারা জানালেন, দিনের শুরুতেই সবাই মিলে গিয়েছিলেন মন্দিরে। সেখানে প্রার্থনা করেছেন অরিত্রীর জন্য। তার আত্মার শান্তির জন্য সবাই উপোসও করেছেন। দুপুর পর্যন্ত সময় কেটে গেছে অরিত্রীর স্মৃতিচারণেই।
অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারী সারাবাংলাকে বলেন, সবকিছুই ঠিক আছে। ঘরটাতে শুধু নেই বড় মামনি (অরিত্রী)। প্রতিদিন ঘরটাতে যাই, জিনিসপত্রের যত্ন করি। কিন্তু ঘরটাতে কেউ থাকে না।
অরিত্রীর ছোটবোন ঐন্দ্রিলা অধিকারী বলেন, দিদিকে ভুলে থাকতে পারি না। সবসময় তাকে নিয়েই আমাদের বসবাস। দিদি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই। তবুও দিদি আমাদের সঙ্গেই বেঁচে থাকবে।
অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী সারাবাংলাকে বলেন, বড় মামনির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাজারবাগ কালি মন্দিরে তার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। আমরা সবাই সেখানে গিয়েছিলাম। আজ সন্ধ্যা ৬টায় বাসায় প্রার্থনা ও স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছে।
অরিত্রীর স্মৃতিকে শুধু নিজেদের মধ্যেই আটকে রাখতে চায় না তার পরিবার। তার নামে সমাজের জন্যও কিছু করার পরিকল্পনার কথা জানালেন তার বাবা দিলীপ অধিকারী। তিনি বলেন, বরগুনায় অরিত্রীর নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। একটি সড়কেরও নামকরণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে অসহায় নারী ও শিশুদের সহায়তা করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
অরিত্রীর ছোট বোন ঐন্দ্রিলাও ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ত। তবে অরিত্রীর আত্মহত্যার পর তার স্কুল পরিবর্তন করা হয়। দিলীপ অধিকারী বলেন, বড় মেয়েকে হারিয়েছি। আরেক মেয়ের ন্যূনতম ক্ষতি হোক, তা চাই না। সেজন্য মেয়ের স্কুল পরিবর্তন করেছি। সেটা নিয়েও অনেক ঝামেলা হয়েছে। এখন সে অন্য স্কুলে ভালোভাবেই পড়ছে। তবে অরিত্রী না থাকার যে শূন্যতা, তা কোনোকিছুতেই ঘুচানোর নয়। এমন কোনো ঘটনা যেন অন্য পরিবারে না ঘটে, সংশ্লিষ্ট সবার কাছে শুধু সেটুকু নিশ্চিত করার দাবি জানাই।
অরিত্রীর আত্মহত্যার পর আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে স্কুলের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন দিলীপ অধিকারী। বাদী হিসেবে সর্বশেষ সে মামলার সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি। মামলা প্রসঙ্গে বলেন, আদালতে বিচার চলছে। সাক্ষ্য দিয়ে এসেছি। আশা করি আদালত ন্যায় বিচার করবেন। আমার মতো আর কেউ যেন মেয়েকে হারিয়ে নিঃস্ব না হয়ে পড়ে, আদালতের রায়ে তেমন বার্তাই প্রত্যাশা থাকবে।
২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান শিক্ষক। এ অভিযোগে পরদিন অরিত্রীর মা-বাবাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী তার স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলে উপাধ্যক্ষ তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। পরে অধ্যক্ষের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এসময় অরিত্রী দ্রুত অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। পরে তার বাবা শান্তিনগরের বাসায় গিয়ে দেখেন, অরিত্রী তার রুমে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে।
এ ঘটনার একদিন পর ৪ ডিসেম্বর দিলীপ অধিকারী রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন। অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্কুল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনা ও শাখা প্রধান জিনাত আক্তারকে বরখাস্ত করা হয়।
গত ২০ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কাজী কামরুল ইসলাম দুই আসামি নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় অভিযোগ থেকে।
গত ১০ জুলাই একই আদালত ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণের আদেশ দেন। সর্বশেষ গত ২৫ নভেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন দিলীপ অধিকারী। ওই দিন আসামিপক্ষের আইনজীবী তাকে জেরা শুরু করলে তা শেষ না হওয়ায় আদালত আগামী ২ ফেব্রুয়ারি বাকি জেরা এবং পরবর্তী সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেন।
আরও পড়ুন-
শিক্ষার্থীদের মানসিকতা আমরা বুঝছি না
অরিত্রী অরিত্রী অধিকারী অরিত্রীর আত্মহত্যা একবছর পূর্তি ভিকারুননিসা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ