‘রোহিঙ্গা সংকট জাতীয় বাজেটে চাপ ফেলতে পারে’
৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৭:০৮
ঢাকা: ২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৯২ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজনের বিপরীতে অক্টোবর পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৬ কোটি ডলার অনুদান পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলো দীর্ঘমেয়াদে তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয় বহন করতে পারবে কিনা- এমন প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে এখন (৩ নভেম্বর) পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ৩০৮ দশমিক শূন্য ২ কোটি টাকা অর্থ ছাড় করা হয়। যা খরচের তুলনায় বড় ধরনের আর্থিক ব্যয় নয়। তবে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্যের আংশিকও যদি বহন করতে হয় তবে তা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর উদ্যোগে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের (রোহিঙ্গা) নাগরিকদের বাংলাদেশে অবস্থান: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’, শীর্ষক বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে হয়। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই কাজের গবেষণা উপদেষ্টা ছিলেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘায়িত হওয়ায় স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষত অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও নিরাপত্তা/রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুমুখী প্রভাব ও ঝুঁকি বিদ্যমান। রোহিঙ্গা শ্রমিকদের সহজলভ্যতার ফলে স্থানীয়দের (উখিয়া ও টেকনাফ) কাজের সুযোগ কমেছে। অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে স্থানীয়রা বিভিন্ন কাজে (লবণ চাষ, চিংড়ি হ্যাচারি, চাষাবাদ) রোহিঙ্গাদের নিয়োজিত করছে। ফলে স্থানীয় দিনমজুরদের মজুরি গড়ে ১৫ শতাংশের বেশি কমেছে। স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের হঠাৎ চাহিদা বৃদ্ধিতে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। এক্ষেত্রে শাকসব্জি থেকে শুরু করে মাছ-মাংসের দাম ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার সড়কগুলোতে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা, মানবিক সহায়তায় নিয়োজিত কর্মী ও সরকারি কর্মকর্তাদের যানবাহন এবং ত্রাণবাহী ট্রাকের অতিরিক্ত চলাচল ও চাপে যানজটসহ রাস্তাঘাটের ক্ষতি হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে ওই এলাকায় যানজট আড়াই গুণ বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পরিবহন ব্যয় বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের বড় অংশ জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে আসছে। ইন্টার-সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের ‘যৌথ সাড়া দান পরিকল্পনা’ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৯২ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজনের বিপরীতে অক্টোবর পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৬ কোটি ডলার অনুদান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সংস্থাভিত্তিক অনুদান প্রাপ্তির ক্ষেত্রে (২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত) জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থার (ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউএফপি, ইউনিসেফ, আইওএম, ইউএনএফপিএ, এফএও, ইউএন ওমেন, ডব্লিউএইচও) তহবিল প্রায় ৪৪ দশমিক ৩ কোটি মার্কিন মিলিয়ন ডলার, যা প্রাপ্ত মোট অর্থের ৮৮ শতাংশ।’
‘দু’টি উপজেলায় স্থানীয় বাসিন্দারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে’, উল্লেখ করে রোহিঙ্গা সংকটের কারণে সামাজিক ঝুঁকি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের আগমনের পর উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় মোট জনসংখ্যার ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল স্থানীয় অধিবাসী এবং ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এছাড়া পূর্বে উখিয়া এবং টেকনাফে প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল যথাক্রমে ৭৯২ ও ৬৮০ জন, যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৩ হাজার ৪৬৮ এবং ২ হাজার ৮৫ জনে দাঁড়িয়েছে। ফলে এই দুটি উপজেলায় স্থানীয় বাসিন্দারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটের প্রভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এগেইনেস্ট ফুড ক্রাইসিসের গ্লোবাল রিপোর্ট-২০১৯’র অনুযায়ী, কক্সবাজারে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা ১৩ লাখ। এদের মধ্যে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা উভয়ই রয়েছে। আবার কক্সবাজার জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোকে তাদের মোট চাহিদার ২৫ শতাংশের অতিরিক্ত রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবায় ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এছাড়া এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে স্থানীয়দের মধ্যে এইডস ছড়ানোর আশঙ্কাও বিদ্যমান। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে স্থানীয় প্রশাসনের ৫০ শতাংশ মানবসম্পদ ও লজিস্টিকস সহায়তা বর্তমানে রোহিঙ্গা সম্পর্কিত কার্যক্রমকে সমর্থন করার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে। ফলে কক্সবাজার জেলাসহ উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি পরিষেবাসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।