অনার্সে ভর্তি হওয়া হলো না মেহেদীর, রয়ে গেল বেতনের জমানো টাকা
১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৩:৩৪
ঢাকা: এবার এইচএসসি পাশ করেছে মেহেদী হাসান। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও দিয়েছিল। কিন্তু টিকেনি। তাই সাত কলেজের যে কোন একটিতে ভর্তি হতে চেয়েছিল। আমরা চার ভাইবোন খুব একটা পড়াশুনা করতে পারি নাই। মেহেদীর ইচ্ছা ছিল সে পড়াশুনা শেষ করবে, ভাল একটা চাকরি করবে। তাই কেরানীগঞ্জের ওই কারখানাতে কাজ করে নিজের পড়াশুনার খরচ চালাত। কিন্তু আগুনে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। কাল থেকে মেহেদী বার বার আমাকে বলেছে- ‘আমি সুস্থ হবোতো? পড়াশুনা করতে পারবো তো?’
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) কেরানীগঞ্জে আগনে দগ্ধ মেহেদীর বড় বোন সোনিয়া আক্তার আহাজারি করছিলেন আর এই প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন। সকালে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট থেকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটের আইসিইউতে স্থানান্তরের পর সেখানেই মারা যান আগুনে দগ্ধ মেহেদী ।
আরও পড়ুন: কেরাণীগঞ্জে প্লাস্টিক কারখানায় আগুন: ঢামেকে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১০
সোনিয়া বলেন, তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল মেহেদি। বাবা আলী হোসেন হার্টের রোগী। সংসারে অস্বচ্ছল থাকায় গত দেড় বছর আগে সে কাজ নেয় পুড়ে যাওয়া কারখানাটিতে। সেখানে নয় হাজার টাকার বেতন পেত। ওভার টাইমও করতো। তখন বেতন আসত সাড়ে এগার হাজার টাকা। কিছু টাকা সংসারে দিত। আর কিছু রেখে দিত পড়াশুনা করার জন্য। কিন্তু আগুনে পুড়ে সব স্বপ্নই এখন ছাই হয়ে গেল । পড়াশুনা করার জন্য তার জমানো টাকাগুলো পড়ে রইল। বলতে বলতে ঢুঁকরে কেঁদে উঠেন সোনিয়া।
বুধবার রাতে দগ্ধ মেহেদির বেড়ের পাশে যাকেই পেয়েছে তাকেই বলেছে , ভাই আমি ভর্তি হতে পারবো তো? সুস্থ হলে আমাকে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিবেন? আমার খুব ইচ্ছা পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজ অথবা কবি নজরুল কলেজে পড়ব। এই দুইটা কলেজ আমার বাড়ির কাছে। ম্যানেজমেন্ট অথবা মার্কেটিংয়ে পড়ব।
সোনিয়া জানান, তাদের বাড়ি দক্ষিন কেরানীগঞ্জের আব্দুল্লাহপুরে। বর্তমানে দক্ষিন কেরানীগঞ্জেরর সুবাড্ডা এলাকায় থাকে। মেহেদী জিনজিরা পিএম পাইলট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে পাশ করে।
মেহেদী গতকাল জানায়, কারখানায় সে সহকারী ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করতো। ঘটনার সময় সে কারখানার পাশের গলিতে ডেলিভারি অফিসের সামনে ছিল। সেখানে তার বসসহ কয়েকজন ছিলেন। পাশেই ছিল গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার। সেখানে একটি সিলিন্ডার লিকেজ হয়ে গ্যাস বেরুচ্ছিল। হঠাৎ আগুনের ফুলকি দেখা দেয়। দৌঁড়াইয়ে বের হতে হতে বিকট আওয়াজ হয় এবং চারিদিকে আগুন ছড়িয়ে পরে।
এরপর আর কিছু মনে নেই মেহিদীর। বলেন, আগুন লাগার সময় এক ইঞ্জিনিয়ার গ্যাস সিলিন্ডারের কাজ করছিল। মুলত সেখান থেকে আগুনের সুত্রপাত হয়। সেই ইঞ্জিনিয়ার দৌঁড়ায়ে এসে বলে আগুন লেগেছে। তখন আমরাও চিৎকার দিতে দিতে বের হতে থাকে। অনেকেই আগুন নিভাতে গিয়ে দগ্ধ হয়। এর আগেও কয়েকবার এই কারখানায় ছোট ছোট আগুন লাগে। কিন্তু এইবার অনেক বড় আকার ধারণ করেছে বলে জানিয়েছিলেন মেহেদী হাসান।
কারখানায় মুলত ওয়ান টাইম প্লেট, গ্লাস ও প্যাকেট তৈরী হতো। দুই শিফটে তিনশ লোক কাজ করে। এর মধ্যে কয়েকজন নারীও আছে। ঘটনার সময় নারীদেরকে আগে বের করে দেওয়া হয়।
রাজধানীর কেরাণীগঞ্জের চুনকুঠিয়ায় প্লাস্টিক কারখানায় আগুনের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে, ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিলেন আরও একজন। সব মিলিয়ে কেরাণীগঞ্জের ওই কারখানায় আগুনের ঘটনায় ১১ জন মারা গেছেন। এর বাইরে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে দগ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন আরও ২৪ জন। বৃহস্পতিবার এদের মধ্যে ১১ জনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটে স্থানান্তর করা হয়।
ঢামেক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দগ্ধদের বেশিরভাগেরই শরীরের পুরোটা পুড়ে গেছে। বিশেষ করে সবার শ্বাসনালী আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। তাদের অনেকের অবস্থা সংকটাপন্ন।
এদিকে, বার্ন ইউনিটের বারান্দা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওয়ার্ড, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও অপারেশন থিয়েটারে স্থানান্তর করা হয়েছে দগ্ধ রোগীদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। আজ সকালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়েছে ১১ জনকে।
এর আগে, বুধবার (১১ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টায় আগুন লাগে কেরাণীগঞ্জের চুনকুঠিয়ায় প্রাইম প্যাক্ট নামের ওই প্লাস্টিক কারখানায়। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রায় সোয়া একঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।