আ. লীগের সম্মেলন: নেতৃত্বে আসছে স্বচ্ছ ও মেধাবী মুখ
১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ১১:৪৪
ঢাকা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন ২০ ও ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে। সরকার ও দলের মধ্যে সাংগঠনিক গতিশীলতাকে আরও সুসংহত করার অভিন্ন লক্ষ্যে সাদামাটা আড়ম্বরে সম্মেলন করতে যাচ্ছে দলটি।
আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে সরকার গঠনের ফলে দলটির নেতাকর্মীরা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। ফলে সহযোগী সংগঠনের মতো দলটির কেন্দ্রীয় সম্মেলনেও ক্লিন ইমেজের দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ নতুন নেতৃত্ব খুঁজছেন তিনি। আর এতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কারণে অনেকেরই কপাল খুলছে। আসন্ন সম্মেলনে সাবেক ছাত্রনেতা ও গ্রহণযোগ্য মেধাবী মুখ কেন্দ্রীয় সংসদে ঠাঁই পেতে যাচ্ছেন বলে বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছে।
দলের নেতারা জানান, আসন্ন সম্মেলনে একমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে সভাপতি পদে অপরিহার্য রেখে বাকি পদে কারও বহাল, কারও পদোন্নতি এবং নতুন মুখের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তরুণদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রতিবারের মতো এবারও নতুন মুখের স্থান হবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির তরুণ নেতাদের আমলনামা সংগ্রহ করেছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নেতারা আরও জানান, টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অঙ্গীকারে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে ক্ষমতাসীন সরকার। সে ধারাবাহিকতায় গত নভেম্বর মাসে দলের কয়েকটি সহযোগী সংগঠন এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের কমিটিতে নতুন নেতৃত্ব আসে। এছাড়াও বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদে ২৯টি জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে স্বচ্ছ ও ত্যাগী নেতাদের ঠাঁই হয়েছে। কোনো কোনো জেলায় পুরানো নেতাদের বহাল রাখা হলেও কোথাও কোথাও নতুন নেতৃত্ব এসেছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য ও সাবেকমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ধারাবাহিক সম্মেলন করে। অতীতে ২০টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি সম্মেলনেই কেন্দ্রীয় কমিটির ২০ থেকে ৩০ ভাগ নেতা বাদ পড়েছেন। যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন, যারা অনিয়ম করেছে তারা বাদ পড়েছেন। সে জায়গায় নতুনদের অন্তর্ভুক্তির সমন্বয়ে কমিটি হয়েছে। আগামীতেও এর ব্যতয় ঘটবে বলে, আমি মনে করি না।’
তরুণ ও নারী নেতৃত্বের আকার কমিটিতে বাড়বে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক খান বলেন, ‘নারী সদস্য সংখ্যা বাড়বে। এটা আমাদের কমিটমেন্ট। এরই মধ্যে আমাদের দলে নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং নারী ও তরুণ নেতৃত্ব বাড়বে বলে আমি মনে করি।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নেতৃত্ব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের যেভাবে পরিবর্তন এসেছে তা থেকে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেও একটি বিরাট পরিবর্তন আসছে। শুধুমাত্র একটি পদে পরিবর্তন আসবে না; সেটি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা জানান, ‘নেত্রী যাদের দিয়ে দল চালাবেন, প্রয়োজন মনে করবেন, দলের দায়িত্ব যাদের দিলে ভালো হয়- এই ধরনের মানুষকেই তিনি নেতৃত্বে আনবেন। সে মন্ত্রীও হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই যে, যে মন্ত্রী আছে তাকে বাদ দেওয়া হতে পারে। এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত কখনও গ্রহণ করা হয়নি। নেত্রী চান, দলের সঙ্গে সরকারের ভারসাম্য বজায় রাখতে।’
দলীয় সূত্র জানায়, এবার ছাত্রলীগের সাবেক ত্যাগী নেতা ও সহযোগী সংগঠনের সাবেক নেতাসহ বিভিন্ন মহলে গ্রহণযোগ্য উদ্যোমী তরুণরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই পাবেন। এছাড়াও রয়েছে দলের গবেষণা সেলসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ-কয়েকজন উদ্যমী তরুণ। দলের জাতীয় কাউন্সিলে নতুন মুখ কারা আসছেন? কারা বাদ পড়ছেন তা নিয়ে দলীয় ঘরানায় কানাঘুষা চলছে। কমিটিতে ব্যাপক রদ-বদলের খবরে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন পদপ্রত্যাশীরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতারা জানান, ‘এবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারুণ্য-নির্ভর মেধাবী মুখদের মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক হুইপ ইকবালুর রহিম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না, শাহাবুদ্দিন ফরাজী, ড. সেলিম মাহমুদ, বিশ্বনাথ সরকার বিটু, সাদেকুর রহমান পরাগ, সাবেক মহিলা এমপি ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের মেয়ে সাবেক মহিলা এমপি মাহজাবিন খালেদ, শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ, শহীদ আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী, ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের মেয়ে সুজাতা হক, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন।
এছাড়াও আলোচনায় এগিয়ে আছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্যও ছিলেন। কিন্তু ২০তম জাতীয় সম্মেলনে তিনি বাদ পড়েন। এছাড়া আলোচনায় আছেন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এ আরাফাত, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, সাবেক ছাত্রনেতা আব্দুল আউয়াল শামীম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা উইলিয়াম প্রলয় সমাদ্দার বাপ্পী, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম মানিক, গাইবান্ধা-২ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব আরা গিনি, সংরক্ষিত মহিলা এমপি আঞ্জুম সুলতানা সীমা।
নতুন কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগেরে সাবেক নেতাদের মধ্যে পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য ইসহাক আলী খান পান্না এগিয়ে আছেন। তিনি ১৯৯৪ থেকে ৯৮ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালে দলের দুর্দিনে গঠিত পর্যবেক্ষক কমিটির সদস্য ছিলেন পান্না।
এ ছাড়াও রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির সদস্য সাদেকুর রহমান পরাগ। তিনি ২১তম জাতীয় সম্মেলনে প্রকাশনা, প্রচারপত্র, পোস্টারসহ সম্মেলনকেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুর রাজ্জাকের বড় ছেলে নাহিম রাজ্জাকের নামও বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। সবচেয়ে কম বয়সে এমপি বনে যাওয়া নাহিম প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রেরণায় এখন তারুণ্যের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন।
এর বাইরে জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে সৈয়দা জাকিয়া নূর এমপির নাম শোনা যাচ্ছে। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ছোট বোন। আলোচনায় নাম রয়েছে মহিলা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি রওশন জাহান সাথীসহ আরও দু-তিনজনের নাম।
২০২০ সালে মুজিব বর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতির কারণে এবার সাদামাটা সাজসজ্জায় সম্মেলন করার কথা আগেই জানিয়েছেন দলের নেতারা। ফলে এবারের সম্মেলনের অতটা আড়ম্বর থাকছে না। কিন্তু নেতৃত্ব পরিবর্তনের বিষয়টা আড়ম্বরেই আলোচনা হচ্ছে। যদিও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর মতো দলটির কেন্দ্রীয় সম্মেলন নিয়ে হার্ডলাইনে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজের মতো করেই সাজাতে চান মূল দলটি। ফলে দুর্নীত ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যারা বিতর্কিত হয়েছেন, এমনকি যারা দলে অনুপ্রবেশকারী তাদের কেউই আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী কমিটিতে ঠাঁই পাচ্ছেন না বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।