শীতের প্রকোপে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা
২১ ডিসেম্বর ২০১৯ ২৩:২০
ঢাকা: শিশু হাসপাতালের ওয়ার্ড-২ এর একটি বেডে ১৪ মাস বয়সী সন্তানের সেবায় ব্যস্ত মা ডা. রাখি। ডা. পুলক জানান, ৩৯তম বিশেষ বিসিএসে নিয়োগ পেয়ে ডা. রাখি পাবনা গিয়েছিলেন চাকরিতে যোগদানের জন্য। সেখানেই নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে এখন শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে তাদের সন্তান।
শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ৪৫ দিন বয়সী সন্তান সুরাইয়াকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আল মামুন। মুন্সিগঞ্জ শ্রীনগর থেকে এসেছেন তিনি। সুরাইয়া প্রায় ১০ দিন থেকে ঠান্ডার সমস্যায় ভুগছে বলে জানালেন তিনি।
কামরাঙ্গীরচর থেকে ঢামেকের বহির্বিভাগে নয় মাসের শিশু ইয়াছিনকে নিয়ে এসেছেন সীমা আক্তার। তিনি জানালেন, কয়েকদিন থেকেই তার ছেলের সর্দি-কাশি ও হালকা জ্বর আছে। স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) ঢাকা শিশু হাসপাতালে সরেজমিনে এমন চিত্রই দেখা গেছে। সারাদেশে শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিভিন্ন রোগ। জ্বর-ঠাণ্ডা, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার পাশাপাশি শ্বাসতন্ত্রজনিত নানা রোগ বেড়ে গেছে। শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, অপেক্ষমাণ রোগীর দীর্ঘ লাইন। হাসপাতালের বহির্বিভাগেও দেখা যায় রোগী নিয়ে অপেক্ষা করছে স্বজনেরা। একই চিত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালেও।
ঢামেকের বহির্বিভাগে দুই মাস বয়সী সন্তান তাকওয়াকে নিয়ে এ্যালিফ্যান্ট রোড স্টাফকোয়ার্টার থেকে এসেছেন চৈতি আক্তার। তিনি বলেন, ‘তিন দিন থেকে তাকওয়ার সর্দি। হালকা কাশি আছে। আজ হাসপাতালে নিয়ে এলাম।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বহির্বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রাজেশ মজুমদার বলেন, ‘শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পরে শিশুদের রোগ কিছুটা বেড়েছে। এদের বেশিরভাগের বয়স দুই বছরের মধ্যে। তবে ছয় মাস থেকে এক বছরের বয়সী বাচ্চার সংখ্যা বেশি। এই শিশুদের অনেকেই সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ব্রংকিউলাইটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত।
নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে তিনি ডা. রাজেশ বলেন, ‘আক্রান্ত রোগীদের বেশির ভাগের বাসা কামরাঙ্গীরচড়, লালবাগ, ইসলামবাগ। ধুলা-বালির মধ্যে এই শিশুরা বেড়ে ওঠে। এসব নানা কারণে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিটাও বেশি।’
ঢামেকের বহির্বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শায়েখ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘শুধুমাত্র শিশুরাই নয়, শ্বাসকষ্ট, ঠাণ্ডাজ্বর, কাশি নিয়ে অনেক রোগী আসছে যাদের বয়স ৫৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। যে শীত পড়েছে, আরও কয়েকদিন স্থায়ী থাকলে রোগী বেড়ে যাবে।’
এদিকে ঢাকা শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশেই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে ১০ মাস বয়সী সন্তান রায়হানকে নিয়ে বসেছিলেন মিরপুর থেকে আসা আয়েশা বেগম। ১৭ ডিসেম্বর থেকে রায়হান ডায়রিয়াতে ভুগছে। পাশেই ছিলেন ধামরাই থেকে আসা নিপা ইসলাম। তার ২৭ দিন বয়সী কন্যা তাবাসসুমের খিচুনি হচ্ছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাবাসসুমের খিচুনি বেড়েছে বলে জানান নিপা।
শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. সুলতানা ইয়াসমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শীতের প্রকোপ বাড়ার পর থেকে ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগ বাড়ছে। জরুরি বিভাগে আসা রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুরা আসছে বেশি। প্রতিদিন অনেক রোগী আসছে এমন সমস্যা নিয়ে। এছাড়াও সর্দি-কাশির সমস্যা নিয়েও আসছে। মূলত আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে।’
শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিজওয়ানুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে আগে প্রতিদিন গড়ে ১৫০-২০০ রোগী আসতো। কিন্তু শীতের প্রকোপ বাড়ার পরে গত দুইদিন প্রায় ৩০০-৩৫০ জন রোগী এসেছে। এদের বেশির ভাগই ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত। অনেকেই আসছে জ্বর ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডায়রিয়া (রোটা ভাইরাস) আক্রান্ত হয়েও অনেকে আসছেন। তাদের আমরা ওয়ার্ডে ভর্তি করাচ্ছি। এছাড়াও শ্বাসতন্ত্রজনিত বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি ব্রঙ্কাইটিস আক্রান্ত শিশুও পাওয়া যাচ্ছে।’
শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সফি আহমেদ মুয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যত শীত বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগের পাশাপাশি নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে রোগীরা আসছেন হাসপাতালে। এছাড়াও নাক, কান ও গলার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যাও কম নয়।
শিশুদের ঠাণ্ডা থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ার শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। শীতকালে বাতাসের আদ্রতা কম থাকায় জীবাণু মুক্ত বাতাসেই উড়ে বেড়ায়। এই জীবাণু খুব সহজেই শিশুদের আক্রমণ করে। এই জীবাণুর শিশুদের শরীরে প্রবেশ করলে নানা রোগের সৃষ্টি হয়। তাই তাদের ঠাণ্ডা থেকে দূরে রাখতে হবে। তাদের গরম কাপড় পড়ানোর পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর রাখতে হবে।’
এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছে, উচ্চ চাপ বলয় ও উত্তর-পশ্চিমা শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ (জেড বায়ু) বেশি সক্রিয় থাকায় এবং কুয়াশা ও জলীয় বাষ্পে আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। এ সময় কুয়াশাস্তর নিচে নেমে আসায় মেঘলা আবহাওয়াও বিরাজ করছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শৈত্য প্রবাহ আরও অন্তত দুই দিন থাকবে বলে জানানো হয়েছে।