‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করা হবে’
৫ জানুয়ারি ২০২০ ২১:২৬
ঢাকা: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হাই বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভালোবাসা দেওয়ার দিন শেষ, এখন থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করা হবে।
রোববার (৫ জানুয়ারি) রাজধানীর নগর ভবনে (ডিএনসিসি) কিউলেক্স ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবছর আগে থেকেই পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে ডিএনসিসি। এ লক্ষ্যে বর্ষাকালের অনেক আগেই বছরের প্রথম অ্যাডভোকেসি বা মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে তারা। নিয়মিত মেয়রের অনুপস্থিতিতে এই সভায় সভাপতিত্ব করেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হাই।
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে যথেষ্ট প্রচার হয়েছে। জনগণ এখন জানে ডেঙ্গু কেনো হয়; আর এটা কীভাবে প্রতিরোধ করতে হয়। এরপরও যদি কেউ সচেতন না হন, তাহলে আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানা করা হবে।’
সভায় ২০১৯ সালের ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে এডিস মশার বিস্তার রোধে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. সানিয়া তহমিনা।
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়ে একসঙ্গে হাসপাতালে যাবে। তখন সবার দিকে ভালো করে নজর দেওয়া যাবে না। নজর দিতে না পারলে কিন্তু মৃত্যুর বিষয়টি চলে আসে। সুতরাং আহ্বান জানাই বিষয়টি নিয়ে কাজ করার।’
সভায় ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, ‘মশক নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে ডিএনসিসির রিসোর্স বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক কীটতত্ত্ববিদদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সে অনুযায়ী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। কিউলেক্স মশা নির্মূলে গবেষণা করে সম্ভাব্য প্রজননক্ষেত্র (হটস্পট) চিহ্নিতের মাধ্যমে সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি চিরুনি অভিযান অব্যাহত থাকবে। ডেঙ্গুর কারণে যাতে আর কোনো প্রাণহানি না ঘটে সেজন্য ডিএনসিসি সবধরনের পদক্ষেপ নেবে।’
সভায় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদা সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, ‘ডেঙ্গুর কারণে গতবছর আমাদের অনেক ভুগতে হয়েছে। আবার আমরাই সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করেছি। মশার বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমাদের আধুনিক ও কার্যকরী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগী হতে হবে।’
কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, ‘এটা মনে করা ভুল হবে যে, গত বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল, এ তা বছর কমে যাবে। আমাদের সারাবছর কাজ করতে হবে। এখন থেকে প্রস্তুত হতে হবে। সামাজিক সংগঠনগুলোকে মশা নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করতে হবে। ফোর্থ জেনারেশন লার্ভিসাইডিংয়ের মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘শুধু ফগিং করে কাজ হবে না, ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট (আইভিএম) করতে হবে। গত বছরের বিভিন্ন ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগোতে হবে।’
গত বছর বিভিন্ন ‘রিপিল্যান্টে’র মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে মশার বিভিন্ন ‘রিপিল্যান্ট’ প্রস্তুত করতে হবে, যাতে অন্য দেশের প্রতি আমাদের নির্ভরতা না থাকে।’
মতবিনিময় সভায় ডিএনসিসির মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে ডা. মাহমুদা আলী এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে ডা. আফসানা আলমগীর খান দুটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন।
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তৃতা করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা, কীটতত্ত্ববিদ ডা. সাইফুর রহমান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিউল্লাহসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সিভিল এভিয়েশনের প্রতিনিধিরা।
সভায় ডিএনসিসির মশক নিয়ন্ত্রণের কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়-
১. এডিস মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে ২০০টি সুয়িং ফগ মেশিন, ২৩৮টি পাল্স ফগ মেশিন, ১৫০টি হার্টসন হস্তচালিত মেশিন, ৩৪০টি প্লাস্টিকের হস্তচালিত মেশিন, ২টি ভেহিকেল মাউটেন্ট ফগার মেশিন, ১০টি মোটর সাইকেলে ফগার ও হস্তচালিত মেশিন সংযোজন এবং ২০টি মিস্ট ব্লোয়ার বা পাওয়ার স্প্রে মেশিন কেনা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও ভেহিকেল মাউটেন্ট ফগার মেশিন কেনার পরিকল্পনা রয়েছে।
২. ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ সম্পর্কে নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ১০ লাখ লিফলেট ও ১৫ লাখ স্টিকার বিতরণের মাধ্যমে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এবং এ কার্যক্রম এখনও চলমান রয়েছে।
৩. কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল (Hot spots) চিহ্নিত করার জন্য দুজন কনসালটেন্ট ও ১০ জন শিক্ষানবিশ কীটতত্ত্ববিদের মাধ্যমে ওয়ার্ডভিত্তিক ১৫ দিনব্যাপী সার্ভে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়া মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ডে ১০ জন করে কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে এবং প্রয়োজন সাপেক্ষে আরও অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
৪. গত বছর কাউন্সিলর, গণ্যমান্য ব্যক্তি, সকল বিভাগীয় প্রধান, রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, সিভিল এভিয়েশন, আইসিডিডিআরবি, ঢাকা ওয়াসা, রাজউক, রিহ্যাব এর সংস্থা, কল্যাণ সোসাইটি/বাড়ি মালিক সমিতির প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে।
৫. ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ৫৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ৩০ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
৬. এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শক্রমে বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনা (স্বল্প মেয়াদী) প্রণয়ন করে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানোসহ অঞ্চল পর্যায়ে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ মেয়াদী (৫ বছর) পরিকল্পনা হিসেবে এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে Integrated Vector Management কর্মপরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৫ জানুয়ারি থেকে মশক নিয়ন্ত্রণে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ১০ টি অঞ্চলে ও ৫৪টি ওয়ার্ডে সচেতনতামূলক সভা ও র্যালি পরিচালনা করা হবে। এছাড়াও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক সভা আয়োজন করা হবে।
৭. কীটনাশকের গুণগত মান ও কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্য ডিএনসিসির কারিগরি কমিটির পরামর্শক্রমে এডিস মশা ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে অধিক কার্যকরী কীটনাশক (ম্যালাথিয়ন) প্রবর্তন করা হয় এবং উক্ত কীটনাশক বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আট হাজার লিটার লার্ভিসাইড, সাত লাখ লিটার এডাল্টিসাইড এবং তিন লাখ লিটার ম্যালেরিয়া ওয়েল-বি প্রয়োগ করা হয়েছে।
৮. মশক নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় এক হাজার বিঘা জলাশয়/ডোবা/পুকুরের জলজ ও কচুরিপানা পরিস্কার করা হয়েছে এবং এ কার্যক্রম চলামান রয়েছে।
৯. কার্যক্রম তদারকির (ট্র্যাকিং) জন্য ২৮৫ জন মশকনিধন কর্মীকে মোবাইল সিম দেওয়া হয়েছে।