গভীর শ্রদ্ধায় দেবী সরস্বতীর বন্দনা
৩০ জানুয়ারি ২০২০ ১৭:২০
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গায়ে কাঁচা হলুদ মেখে কনকনে ঠাণ্ডায় স্নান, তারপর পরিষ্কার কাপড় পরে পূজার থালা সাজানোর কাজ; ফলমূল, মিষ্টি, সন্দেশ, ফুল, বেলপাতা আর বই দিয়ে পূজার থালা প্রস্তুত করা, মন্দিরে গিয়ে দেবী সরস্বতীর চরণে সাজানো থালা ও পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ…। ভক্তদের সম্মিলিত স্বরে ‘নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে। বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে। জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে। বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে’ পূজিত হন বিদ্যার দেবী।
সরস্বতী পূজার সকালটা এভাবেই শুরু করেন সনাতন ধর্মবিশ্বাসীরা।
প্রতিবছরের মতো এবারও ভক্তদের বন্দনা ও গভীর শ্রদ্ধায় পালিত হলো সরস্বতী পূজা। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, মাঘ মাসের শুক্লাপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা হয়। সেই অনুযায়ী আজ (৩০ জানুয়ারি) পঞ্চমী তিথিতে ধর্মীয় আচার মেনে মন্দিরে মন্দিরে পালিত হলো দেবী সরস্বতীর পূজা-অর্চনা।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, আজ ভোর থেকে সকাল ১১টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত পঞ্চমী তিথি। এই সময়ের মধ্যেই মন্ডপগুলোতে পূজা ও অঞ্জলির কাজ শেষ হয়েছে। শিশুদের বিদ্যাচর্চার সূচনা হিসেবে ‘হাতেখড়ি’ও এই সময়েই অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে ৭০টি মণ্ডপে পূজা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের আর্থিক সহযোগিতায় মন্ডপগুলো তৈরি করা হয়েছে। কয়েকটি বিভাগ মণ্ডপ সাজানোর ক্ষেত্রে ‘থিম’কে গুরুত্ব দিয়েছে। অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নিখিল দাস বলেন, ‘আমাদের বিভাগের মন্ডপ সাজানোর ক্ষেত্রে ‘ড্রাগ বা মাদক’কে তুলে ধরা হয়েছে। মাদকের কারণে সমাজে প্রতিনিয়ত যে অবক্ষয় সৃষ্টি হচ্ছে সেই বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যেন বাধা না পায় সেজন্য মাদকমুক্ত সমাজ নির্মাণ করা উচিত। তাই আমরা এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছি।’
ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল টেকনোলজি (আইআইটি) বিভাগও একটি থিম অনুযায়ী মন্ডপ সাজিয়েছে। দৈনন্দিন ব্যবহৃত নানা অ্যাপসের ছবি (ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি) দিয়ে মন্ডপের ব্যাকগ্রাউন্ডের ডিজাইন করা হয়েছে। বিভাগের এক শিক্ষার্থী বললেন, ‘প্রযুক্তি ছাড়া মানুষের জীবন অচল। তাই এই বিষয়টিকে বেছে নিয়েছি আমরা।’
এবারের মন্ডপ সাজানোর ক্ষেত্রে ‘পরমাণু গঠনের মডেল’ থিম হিসেবে বেছে নিয়েছে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা চিংড়ির আদলে গড়ে তুলেছেন মন্ডপ। অপূর্ব কারুকাজে ফুটিয়ে তোলা চিংড়ি দেখে বিস্মিত হতেই হয়। প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্ন মাছের আদলে মন্ডপের কারুকাজ করা হয়, জানালেন বিভাগের এক শিক্ষার্থী।
কিছু বিভাগ অবশ্য নির্দিষ্ট থিমে নয়, নিজেদের পছন্দমতো ডিজাইনে মণ্ডপের ভেতর ও বাইরের কারুকাজ করেছে। তাদের চেষ্টায় সূক্ষ্ম সেই কারুকাজ ভিন্নভাবে নান্দনিকতার পরশ বুলিয়েছে।
এছাড়া প্রতিবছরের ন্যায় এবারও চারুকলা বিভাগ অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে সরস্বতী মূর্তি গড়েছেন। পাট ও ককশিট দিয়ে তৈরি এই মূর্তি জগন্নাথ হলের পুকুরের ঠিক মধ্যখানে সাজানো হয়েছে। অপূর্ব মূর্তিটি একনজর দেখতে ভিড় করছেন উৎসুক সবাই। জগন্নাথ হলের উপাসানলয়ে অঞ্জলি দিতে এসেছেন মাধব কুন্ডু। তিনি বলেন, ৯ টা থেকেই অঞ্জলি শুরু হয়েছে। প্রথম দফায় লোকসমাগম বেশি থাকায় অঞ্জলি দেননি। দ্বিতীয় দফায় অঞ্জলি দিয়েছেন। অঞ্জলি শেষে ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়েছে।
মন্ডপে মন্ডপে পূজা, আরতি, মন্ত্র পাঠ আর ধূপের সুগন্ধ- পুরো পরিবেশকে মাতিয়ে রেখেছিল। শুধু সনাতন ধর্মালম্বীরাই নয়, পূজা উপভোগ করতে এসেছিলেন অন্য ধর্মের মানুষও। রুবাইয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শাড়ি পরে বন্ধুদের সঙ্গে পূজা দেখতে এসেছেন। অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার। তা না হলে সাম্প্রদায়িকতার ছোবল থেকে আমরা কেউই বের হতে পারবো না। যেকোন ধর্মীয় উৎসবেই উপভোগ করতে পছন্দ করি। ঘুরে বেড়াই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেই।’
সরস্বতী দেবীকে বলা হয় ‘বীণা ও পুস্তকহস্তা’। দেবীর একহাতে থাকে পুস্তক বা বই এবং অন্যহাতে থাকে বীণা। সেই অর্থে, বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতী।
শ্বেত বা সাদা রঙেই সারস্বতীর অধিষ্ঠান। সাদা ‘শুভ্রতার’ প্রতীক। সরস্বতী সনাতন ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলার দেবী। দেবীর আশীর্বাদে জ্ঞান ও বিদ্যায় শুদ্ধতা লাভ হয়। সেই অর্থে, শুদ্ধতার প্রতীক হলো সাদা। শাস্ত্র অনুযায়ী, সাদা রাজহংসে চড়ে দেবী পৃথিবীতে আসেন।
সনাতন পরিবারগুলোতে ঘরেই সরস্বতী দেবীর পূজা করা হয়। তবে তরুণরা এই পূজাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী পূজা শিক্ষার্থীদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
শাস্ত্র অনুযায়ী, সরস্বতী পূজার দিন শিক্ষার্থীদের পাঠ বা পড়াশুনা বন্ধ রাখতে হয়। সেদিন নিজের বই দেবীর চরণে নিবেদন করতে হয়। পূজার পরের দিন সকাল বেলা স্নান করে বেলপাতায় দেবী সরস্বতীর নাম তিনবার লিখে বইয়ের ভেতরে রাখতে হয়। দেবীর আশীর্বাদস্বরূপ এই বেলপাতা বইয়ের ভেতরে থাকে।
দেশ, কালভেদে সরস্বতী পূজার রীতিনীতি ও আচারে পরিবর্তন লক্ষ করা গেলেও এই পূজা সর্বজনীন। জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজা তাই প্রতিবছর ব্যাপক আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়। বয়স ও লিঙ্গভেদে প্রত্যেক সনাতন ধর্মবিশ্বাসীরা দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।