সোফিয়ার মতো কথা বলতে পারে বাংলাদেশের রোবটও
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৩:২৩
এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা : ব্যাংরো। একটি রোবটের নাম। কথা বলতে পারে সৌদি আরবের নাগরিক রোবট সোফিয়ার মতো। নির্দেশনা দেওয়া হলে এগিয়ে চলে সামনের দিকে। পেছনে আসতে বলা হলে চলে আসে পূর্বের স্থানেই। করতে পারে হ্যান্ডশেকও। শুধু তাই নয়, ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারে তথ্যও।
‘প্রায়-অবিকল’ সুফিয়ার মতো এ রোবটটি তৈরি করেছে বাংলাদেশেরই একদল তরুণ। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের ৮ শিক্ষার্থীর তৈরিকৃত এই রোবটটির দেখা মিলছে রাজধানীতে চলমান ‘বেসিস সফটএক্সপো-২০১৮’তে- যা চলছে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি)।
শিক্ষার্থী ফরিদ হোসেনের নেতৃত্বে এই রোবটি তৈরি হয়েছে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাংলা রোবট থেকে ব্যাংরো শব্দটি এসেছে। তবে এটি এখনও ডামি (নমুনা) পর্যায়ে রয়েছে।’
রোবট ব্যাংরোর সঙ্গে কারিগরি টিম
তিনি জানান, রোবটটি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় কথা বলতে পারে। উন্নত ভয়েস ও ইমেজ রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এর সামনে থাকা মানুষকে চিনতে পারে। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সামনে থাকা মানুষের সঙ্গে করতে পারে যোগাযোগও।
ফরিদ বলেন, ‘আমরা এটাকে সুফিয়ার মতো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স করব। তবে বাংলা ভাষায় ভয়েস কমান্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখনও বাংলা ভাষার ভয়েস রিকগনিশন এপিআই নেই। ফলে রোবট সহজে বাংলা ভাষায় কমান্ড নিতে পারে না। কথা বললে অনেক সময় ইংরেজদের মতো বাংলা বলে। নির্দেশ দেয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা- যা নিয়ে দেশের রোবট বিশেষজ্ঞরাও কাজ করছেন।’
রোবটিটি তৈরিতে সার্বিক সহায়তা করেছে মাস্টার ল্যাবস নামক রোবটিক ল্যাব। আর এটিকে বর্তমানের পর্যায়ে নিয়ে আসতে খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। যার সবটাই বহন করতে হয়েছে ফরিদ ও তার বন্ধুদের। রোবটটি তৈরিতে রাহাত উদ্দিন ও এহসানুল হক রানাসহ কাজ করেছেন আরও ছয় সহপাঠী, যাদের সবাই ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের ৮ম পর্বের শিক্ষার্থী।
ব্যাংরোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন কারিগররা
জানতে চাইলে রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট কম্পিটিশনে অংশ নিতে গিয়ে আমাদের একটা প্রজেক্ট জমা দিতে হয়। সেই প্রজেক্ট জমা দিতে গিয়েই আমরা ব্যাংরো তৈরি করেছি। এর পুরো কৃতিত্ব বন্ধু ফরিদের।’
তিনি বলেন, ‘সোফিয়া আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রোবটকে যে কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারে। আমাদের রোবটটিও ইনফরমেটিক। ম্যানুয়ালি আমরা যে প্রশ্নটি ঠিক করে দিই, এটি তার উত্তর দিতে পারে। এটি নিয়ে এখনও কাজ চলছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নত করা হবে।’
রানা জানায়, তাদের এ রোবট ইলেক্ট্রনিক ও পোগ্রামিংয়ের ওপর নির্ভর করছে। যার সফটওয়্যারও তাদের তৈরি। তবে রোবটের যন্ত্রপাতি কেনায় তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। দেশে যেমন এর যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না, তেমনি দামও পড়ে বেশি। এছাড়া কেনাকাটায়ও রয়েছে বেশ ঝামেলা।
এবারের এক্সপোতে দেখা গেল অন্য আরেকটি দলের তৈরি ‘রোবটিক আর্ম’। ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একদল শিক্ষার্থী রোবটের এই হাতটি তৈরি করেছে। এটি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মালামাল স্থানান্তর করতে পারে।
এ দলের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থী এনায়েত উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোবট হয়ে উঠবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অংশ। ভবিষ্যতে দেশের কলকারখানায়ও ক্রমাগত এর ব্যবহার বাড়তে থাকবে। আমাদের তৈরি এই রোবটিক আর্ম মেডিসিন প্যাকেজিং ও বিস্কুটের কারখানাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।’
সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পাওয়া রোবট সোফিয়া। গত বছর ঢাকায় আয়োজিত ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড এক্সপো’তে আসেন এই রোবট
‘বঙ্গবীর’ নামের অপর আরেকটি রোবটও এবারের এক্সপোতে প্রদর্শিত হচ্ছে। এটি তৈরি করেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী।
ওই দলের সদস্য ফাতিন হাসনাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তৈরি এই রোবটটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গী হয়েও উঠতে পারে। এর রোবটিক আর্ম দিয়ে গাছে পানি ঢালা যাবে। ঘরে থাকা নিত্য প্রয়োজনীয় ছোট জিনিস সরানো যাবে এক যায়গা থেকে আরেক যায়গায়। ফেস ডিটেক্টর ব্যবহৃত হওয়ায় ঘরে অপরিচিত মানুষ ঢুকলে দিতে পারবে সংকেত। এমনকি দিতে পারে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তরও।’
রোবট তৈরির প্রতিবন্ধকতা জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স ক্লাবের সদস্য আদিল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে টেকশপ বলতে গেলে খুবই কম এবং দামে একচেটিয়া। রোবটিক্স উপাদানগুলো কিন্তু ইলেক্ট্রনিক্স দোকানে গেলে পাওয়া যাবে না। হাতেগোনা কয়েকটি ওয়েবসাইট আছে। এরমধ্যে টেকশপ বিডি অন্যতম- যারাই প্রথম দেশে রোবটিক উপাদান আনতে শুরু করে। তারা একসময় খুব দাম রাখতো। তবে ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতায় আসছে। অন্য আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে- অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম। প্যাপল না থাকায় কোন একটি যন্ত্রাংশ কিনতে দ্বিগুণ দাম দিতে হচ্ছে।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও রোবটিক্স নিয়ে অনেক দিন থেকেই কাজ হচ্ছে। আমরা এখন সবগুলো উদ্ভাবনকে একসাথে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। কারণ আলাদা আলাদা থাকলে এগুলো হারিয়ে যায়।’
রোবট ব্যাংরো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যত কিন্তু নির্ভর করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ওপর। তরুণদের এ অগ্রগতি দেখে বলতে পারি, আমরা যদি আমাদের মেধাকে বিনিয়োগ করতে পারি তবে ভবিষ্যতে সোফিয়ার চেয়েও ভালো রোবট তৈরি করতে পারব।’
সারবাংলা/ইএইচটি/একে