করোনাভাইরাস: চীন নিয়ে শঙ্কা ও সতর্ক দৃষ্টি বাংলাদেশের
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২১:২০
ঢাকা: প্রযুক্তি আর বাণিজ্যে যে দেশ বিশ্বের ওপর ছড়ি ঘুড়িয়ে চলছে, হঠাৎই তার ছন্দপতন। পরিস্থিতি চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সে তথ্য স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে দেশটির শীর্ষ নেতৃত্ব। বলা হচ্ছে চীনের কথা। আর তার শত্রু এখন করোনাভাইরাস।
অর্থনীতিদিদের মতে, বিশ্বের ১৩ শতাংশ বাণিজ্য কোনো না কোনোভাবে চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই সম্পৃক্ততাই এখন হুমকির মুখে। এরই মধ্যে কয়েকটি দেশের শীর্ষ এয়ারলাইন্স ঘোষণাই দিয়েছে, তারা চীনে যেতে চায় না। প্রায় সবদেশ নিজের নাগরিকদের বলছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যেন চীনে কেউ না যায়। ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও এর প্রভাব নিয়ে তীব্র শঙ্কায় সবাই।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা আলোচনা করছেন শিগগিরই করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারলে এর সম্ভাব্য নতুন সমস্যা নিয়ে। তারা বলছেন, চীন-নির্ভর পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হবে। যদিও এরই মধ্যে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল আমদানিতে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে চীনা বিনিয়োগ ও উন্নয়ন প্রকল্পেও।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, গত এক দশকে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ চীনের। প্রায় ১০ হাজার চীনা নাগরিক ব্যবসা বাণিজ্য ও নানা পেশায় জড়িত রয়েছে এ দেশে। দেশের রফতানিজাত পণ্যের ৭০ শতাংশ কাঁচামালও আসে চীন থেকে। নিত্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ চীন-নির্ভর। এমন বাস্তবতায় চীনে অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে এর প্রভাব থেকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাব নির্ভর করবে এর স্থায়িত্ব ও ব্যাপ্তির ওপর। অল্প সময় হলেও এরই মধ্যে বেশকিছু অভিঘাত দেখা যাচ্ছে। চীন-নির্ভর অবকাঠামোগত তৈরিতে প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে। গার্মেন্টসের প্রাথমিক উপকরণ নিয়ে চীন থেকে কন্টেইনার ঠিক সময়ে আসবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ কাঁচামাল দেরিতে এলে উৎপাদনে তার প্রভাব পড়বে। প্রভাব পড়ছে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে। এছাড়া, চীনা শ্রমিকরা দেশে ফিরতে দেরি করছেন। আবার তাদের সঙ্গে যারা কাজ করছেন তারাও উদ্বিগ্ন।
‘করোনাভাইরাস স্থায়ী হলে চীনসহ পুরো বিশ্বের অর্থনীতি হোঁচট খাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। বিশ্বের ১৩ শতাংশ বাণিজ্য কোনো না কোনোভাবে চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ এটি স্থায়ী হলে পুরো বিশ্বের সাপ্লাই চেইনে (সরবরাহ ব্যবস্থা) ঘাটতি তৈরি হবে, যা বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে,’— বলেন মোস্তাফিজুর রহমান।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের আমদানির শতকরা ৩০ ভাগ আসে চীন থেকে। খুচরা যন্ত্রপাতি ও গার্মেন্টসের প্রাথমিক উপকরণ আমদানি বাধাগ্রস্ত হলে উৎপাদনে এর প্রভাব পড়বে। আমদানির বিরূপ প্রভাব পড়বে উৎপাদন ও রফতানিতেও। এছাড়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে জড়িত চীনাদের দেশের জন্য মন খারাপ থাকবে। এতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ কিছুটা হলেও স্থবিরতা আসতে পারে। আর চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতেও মন্থরতা দেখা দিবে, যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, করোনোভাইরাসের প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে এখনই প্রভাব পড়েছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্য গভীরভাবে সম্পৃক্ত। চীন বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে। দেশটিতে করোনার প্রভাব দীর্ঘামেয়াদি হলে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগে স্থবিরতা আসবে। উপকরণ আমদানি বন্ধ হলে অনেক পণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হবে। হোঁচট খেতে পারে রফতানি আয়। বিঘ্নিত হতে পারে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। বাড়তে পারে চীন থেকে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের দাম।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, গত বছর আমরা চীনের বাজারে ৫৫ কোটি ডলার ফিনিশড প্রোডাক্ট রফতানি করেছি। এছাড়া, চীন থেকে আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে আমরা টেক্সটাইল ও কাঁচামাল মিলিয়ে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছি, যা আমাদের পুরো গার্মেন্টস খাতের অর্ধেক। সোয়েটার আর ওভেন খাত মূলত চীনের কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। যদিও মধ্য জানুয়ারি থেকে আমরা দেখছি, বন্দরে নোঙর থাকা জাহাজের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। তবে পরিস্থিতি জটিল হলে এটি আর নিয়ন্ত্রণে থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে।
এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, চীন তাদের হলিডের সময় বাড়িয়েছে। ছুটি দীর্ঘায়িত হওয়ায় একটি ধাক্কা লাগবে। কারণ ওখান থেকে প্রাথমিক উপকরণ আনতে পারব কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। চায়নার সঙ্গে চলাচল বন্ধ থাকায় বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বে। শুধু গার্মেন্টস নয়, সব খাতেই ধাক্কা লাগবে।
বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ সভাপতি ফয়সাল সামাদ সারাবাংলাকে বলেন, চীনে এখনও হলিডে চলছে। কারখানাগুলো খুলবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। হয়তো খুলতেও পারে, আবার নাও পারে। ব্যবসার ক্ষেত্রে আসলে বলা মুশকিল পোশাক খাতের জন্য এটি ইতিবাচক হবে কি না। আরও সপ্তাহখানেক লাগবে, তারপরে আসল চিত্র বোঝা যাবে। তবে সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরাও সতর্ক আছি।
দুই দেশের বাণিজ্য পরিস্থিতি
২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করেছিল ৪০১ মিলিয়ন ডলার, বিপরীতে আমদানি করে ৬ হাজার ৪১১ মিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীনে রফতানি হয়েছে ৮৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। বিপরীতে আমদানি হয়েছে ১৩ হাজার ৮৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। চীন থেকে টেক্সটাইল, ফ্রেব্রিক্স, মেশিনারিজ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক ও রাবার, খনিজ, গাড়ি, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বেশকিছু পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। স্থানীয় বাজার বলছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দাম বেড়ে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
অর্থনীতি উন্নয়ন প্রকল্প করোনাভাইরাস গার্মেন্টস খাত চীনা বিনিয়োগ বাণিজ্য