‘টালমাটাল’ অর্থনীতি প্রভাব ফেলবে জনজীবনে
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২১:২৯
ঢাকা: রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ছাড়া দেশীয় অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই এখন নিম্নমুখী। উল্টো পথে চলছে রাজস্ব আয়ও। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই রাজস্ব খাতে ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকা। চলতি মাসে পুঁজিবাজারের সূচকও নেমেছিল এ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে। এর মধ্যেই অর্থনীতিতে বড় ঝাঁকুনির শঙ্কা জানিয়ে চোখ রাঙাচ্ছে করোনাভাইরাস! অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুকৌশলে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারলে তা জনজীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ রেখেছিল সরকার। রাজস্ব খাতের হালনাগাদ তথ্য বলছে, এই ছয় মাসে রাজস্ব আয় ছিল এক লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ শতাংশ।
একই পরিস্থিতি পুঁজিবাজারেও। ১১ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ টানা পাঁচ কার্যদিবসে পূঁজিবাজারের ছিল সূচকের পতন। তালিকাভুক্ত ৯৫ শতাংশ কোম্পানির প্রান্তিক আয় কমে যাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে অন্য একটি সূত্র বলছে, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় চীন থেকে কাঁচামালের আমদানিতে ভাটা পড়েছে। আগামী মাসগুলোতে আমদানি আরও কমে গেলে কারখানাগুলো মুনাফা সংকটে পড়বে। এমন আশঙ্কা থেকেই বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। আর তাতেই এমন ধারাবাহিক দরপতন হয়েছে।
এর মাঝে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দিয়েছে আরও একটি হাতাশার খবর। তাদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বেড়েছে। এ মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা গত বছরের প্রথম মাসে ছিল ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) আবার জানাচ্ছে, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি) ২ হাজার ২৯১ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে দেশ থেকে। এই আয় যেমন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ শতাংশ কম, তেমনি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়েও ৫ দশমিক ২১ শতাংশ কম।
অর্থনীতির এমন সূচকগুলোর নিম্নমুখী প্রবণতা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবগুলো সূচকই এখন নিম্নমুখী। আমদানি, রফতানি অনেক কমে গেছে। মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। অর্থনীতির এই টালমাটাল অবস্থা সামাল দেওয়া না গেলে এর প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে। আর এটা অদূর ভবিষ্যতে কারও জন্যই ভালো ফল বয়ে আনবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক আবুল বারাকাতের মতও সালেহউদ্দিন আহমেদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নয়। তবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে পুরোপুরি খারাপ বলতে নারাজ তিনি। তার মতে, বিশ্ব অর্থনীতির মতো দেশীয় অর্থনীতিতেও করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়ছে। তবে চাইলেই এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব।
জনতা ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, সারাবিশ্বেই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন খারাপ। করোনাভাইরাসের কারণে আরও খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। চীন থেকে যন্ত্রাংশ নিতে না পারায় কোরিয়ান হুন্দাইয়ের মতো কোম্পানি তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এমন অনেক ছোট কোম্পানি রয়েছে, দেশীয় অর্থনীতিতে যাদের প্রভাব বিস্তর। করোনাভাইরাসের কারণে সেগুলোও এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
আবুল বারাকাত বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হলো লেদার, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক রফতানি। এই খাতগুলোতে আমরা চীনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এসব খাতের ছোট কারখানাগুলো চীন থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করে চলে। আবার সে দেশে বিপুল পরিমাণ পণ্যও রফতানি করে। কিন্তু করোনা আতঙ্কে চীনের অনেক শহর এখন জনশূন্য। ফলে তারা যন্ত্রাংশ বা অন্য কাঁচামাল দিতে পারছে না। আবার তারা আমদানিও কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।
বর্তমান এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সংশ্লিষ্ট সবার সততার দিকে জোর দিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জানেন, সমস্যা কোথায়। সমস্যা চিহ্নিত করে এরপর সেটা সমাধান করতে হবে। অন্যায় সুবিধা দেওয়া বন্ধ করতে হবে, স্বার্থান্বেষীদের প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতি করতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ গোটা ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। এই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলে অনেক কিছুই ইতিবাচক পথে বদলে যাবে। সরকারের সামনে বীমা ও পুঁজিবাজারও এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও রাজস্ব আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করতে হবে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। তা না পারলে দেশ অচিরেই বড় অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
কারখানা ও ব্যাংকগুলোর মধ্যেকার সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিয়ে আবুল বলেন, এই যে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ও লেদার কারখানাগুলো রয়েছে, বেশিরভাগই কিন্তু ব্যাংক ঋণে চলে। ওদের দু’টো শিপমেন্ট মার গেলে ওরা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ব্যাংকও তখন সহযোগিতা না করে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকে। এরকম মনোভাব থেকে বের হতে হবে। না হলে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পদ্মাসেতুকে ঘিরে ব্যাপক শিল্পায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বারাকাত। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য পদ্মাসেতু চমৎকার হতে পারে, যদি এর চারপাশের জেলাগুলোতে পরিকল্পনা করে ইকোনমিক জোন তৈরি করা হয়। কেবল মানুষ পারাপার করার টোল নিয়ে পদ্মাসেতুর খরচ তোলা যাবে না। প্রচুর পণ্য পরিবহন করতে হবে। তাতে সেতুর টাকাও উঠবে, দেশের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে। অর্থনৈতিক জোনগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়, কিন্তু ওই পরিবেশে বাস করা মানুষগুলো যেন উপকার পায়। মানুষের উপকার হলে দেশও উপকৃত হবে।
ব্যাংকে আমানতে ‘সিংগেল ডিজিট ইন্টারেস্ট’ শিল্পায়ন বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করেন আবুল বারাকাত। তিনি বলেন, দেশের শিল্পায়নের চাকা সচল রাখতে ব্যাংকের আমানতে ইন্টারেস্ট রেট সিংগেল ডিজিট রাখতে হবে। তাহলে ব্যাংক ঋণ নিয়ে আর টাকা ফেলে রাখার সম্ভাবনা থাকবে না। টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য শিল্প-কারখানায় লগ্নি করতে হবে। শিল্প-কারখানায় যত লগ্নি বাড়বে, দেশের অর্থনীতির চাকা ততই সচল হবে। সেটি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্টিও হতে পারে, আবার লাইট কিংবা হেভি ইন্ডাস্ট্রিও হতে পারে।
বিশ্বজুড়েই অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা
এদিকে, বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে চলতি বছর ভালো কোনো আশা করতে পারছেন না। তাদের মতে, চলতি বছরটি হবে অর্থনৈতিকভাবে একটি দুর্বল বছর। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গতবছরের তুলনায় এবার বৈশ্বিক উৎপাদন বাড়বে। গত বছর বৈশ্বিক উৎপাদন ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ, যা চলতি শতকের সর্বনিম্ন। এ বছর উৎপাদন ২ দশমিক ৫ শতাংশে উঠতে পারে। সেটি হলেও তা হবে শতকের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
অক্সফোর্ড ইকোনমিকসও কথা বলছে বিশ্বব্যাংকের সুরেই। তারা বলছে, এ বছর বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিবেশ স্বাভাবিক ও স্থির থাকবে। চলতি বছরে বড় কোনো অর্থনৈতিক অর্জন সম্ভব হবে না। এজন্য মহামারী, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঋণপ্রবৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা আর ভোক্তা ব্যয়কে কারণ হিসেবে দেখিয়েছে তারা।
তবে এসব বৈশ্বিক বিশ্লেষণে চিন্তিত হতে ‘নিষেধ’ করেছেন আবুল বারকাত ও সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তাদের মতে, ব্যবসায় পরিবেশের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ, উন্নত কর নীতি প্রণয়ন, উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বাড়ানো ও ছোট ছোট শিল্প কারখানাগুলো রক্ষা করা গেলে এই পরিস্থিতিতে উৎরে যেতে পারবে বাংলাদেশ। আর এমনটা যদি করা না যায়, তবেই কেবল পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাত্রা করতে পারে।
অর্থনীতি অর্থনৈতিক অবস্থা অর্থনৈতিক সূচক আবুল বারাকাত পুুঁজিবাজার রফতানি রাজস্ব আয় রেমিট্যান্স সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ