আগুনে সব হারালেও আশা হারাননি তারা
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:৪৩
ঢাকা: আগে কড়াইল বস্তিতে ছিলেন আবুল হোসেন। মাত্র তিন মাস আগে রাজধানীর বনানীর টিঅ্যান্ডটি বস্তিতে আসেন তিনি। ৩ হাত বাই ৪ হাতের একটি ঘর তুলে স্ত্রী-সন্তানসহ বাস করতে শুরু করেন। বস্তির পাশে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে সেখানে ভাঙ্গারির ব্যবসা করতেন।
গত শনিবারের ভয়াবহ আগুনে এই বস্তির অন্য সকলের মতো আবুল হোসেনও হারিয়েছেন সব। তবে সব হারিয়েও হাল ছাড়েননি তিনি। জানালেন, এখন তাবু টাঙিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। নতুন ঘর তোলার টাকা জোগাড় করতে পারলেই আবার ঘর বাঁধবেন।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সারাবাংলার সঙ্গে আলাপের সময় এমন প্রত্যয়ই জানালেন আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সব হারিয়ে ভোলা থেকে ১০ বছর আগে ঢাকায় এসেছি। আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। তাই এই বস্তিকে ঘিরেই আমরা স্বপ্ন দেখি।’
আগুনের ঘটনার স্মৃতি আউড়ে তিনি বলেন, ‘ওইদিন রাত ৩টার দিকে আগুন, আগুন চিৎকার শুনে বাইরে বের হয়ে দেখি, বস্তির উত্তর দিকে আগুন জ্বলছে। তখনও পুরো বস্তিটাই অক্ষত ছিল। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে সময় লেগেছে অনেক। এরপর তো চোখের সামনেই সব পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগুনে পোড়ার পর কোথাও যাইনি। এখানেই তাবু টাঙিয়ে রাত্রি যাপন করছি। রোববার ৩০ কেজি চাল, ২ হাজার টাকা, একটি কম্বল ও একটি লুঙ্গি পেয়েছি। ঘর তোলার টাকা এখনো হয় নাই। টাকা হলে আবার ঘর তুলবো এখানে।’
ভয়াবহ আগুনে সব হারিয়ে গত পাঁচদিন ধরে খোলা আকাশের নিচেই বসবাস করছেন আবুল হোসেনের মতো হাজারো মানুষ। সবারই প্রত্যাশা, আবার ঘর তুলবেন, আবার আগের জীবনে ফিরে যাবেন।
১৮ বছর ধরে এই টিঅ্যান্ডটি বস্তিতে বাস করছেন আঙ্কুর বেগম। স্বামীহারা এই নারী তার চার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তিনটি ঘরে বাস করতেন। আরও দুইটি ঘর ভাড়া দিতেন। তার দুই ছেলে রিকশা চালক। ঘর ভাড়া আর ছেলেদের উপার্জন দিয়ে সংসার চালাতেন। দীর্ঘ ১৮ বছরে এই প্রথম তাদের বস্তিতে আগুন লাগতে দেখলেন তিনি।
সারাবাংলাকে আঙ্কুর বেগম বলেন, ‘পরনের কাপড় ছাড়া সাথে কিছু নিয়ে বের হতে পারিনি। সব হারিয়ে খোলা আকাশের নীচে ওপরে কাপড় টাঙিয়ে রাতে বাস করছি। দিনের বেলায় আরাম করার ব্যবস্থা নেই। রাতের বেলা প্রচন্ড ঠান্ডা পরে। ঘর করার মতো এখনো টাকা যোগাড় হয়নি। তবে যেদিন টাকা হবে সেদিন ঘর তুলবো। সে অপেক্ষাতেই আছি।’
চাল, টাকা আর কাপড় ত্রাণ হিসেবে পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
কথা হয় প্রায় ৭০ বছর বয়সী ছানোয়ারা বেগমের সঙ্গে। জানালেন, তার বাড়ি কুমিল্লা। কিন্তু গত ২০ বছর ধরে এই বস্তিতেই বাস। এখানেই স্বামীকে হারিয়েছেন। এখন রিকশাচালক সন্তানের সঙ্গে থাকেন। চারটি ঘর ছিল তাদের, দুটিতে নিজেরা থাকতেন আর দুটি ভাড়া দিতেন। সব মিলিয়েই চলতো সংসার। এখন সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
সারাবাংলার প্রতিবেদককে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন এই বৃদ্ধা। বলেন, ‘একটা কম্বল পেয়েছি আর একটা শাড়ি পেয়েছি। টাকা পেয়েছি ৭ হাজার। এই টাকা দিয়ে তো ঘর হয় না। কোনো রকমে ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি আবারও। শুধু ঘরটা উঠাতে পারলেই জীবনের বাকী সময়টুকু কেটে যাবে। সেই ঘরটাই যে কবে উঠাতে পারি তা বুঝতে পারছি না।’
আগুন লাগার পর কেউ বস্তির বাইরে যায়নি, সবাই এখানেই কষ্ট করেই আছেন বলে জানালেন বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে এত কম টাকায় কোথাও থাকা যাবে না। তাই কেউ সহজে এই জায়গা ছাড়তে চায় না। শহরের মাঝখানে কেউ রিকশা চালায়, কেউ ভ্যান চালায়, আবার কেউ বাড়িতে কাজ করে। বেশি রাত হলেও এখানে আসতে সমস্যা হয় না। অন্য জায়গায় গেলে তো অনেক সমস্যা হয়।’
তবে আগুন কিভাবে লেগেছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্যই দিতে পারেননি বস্তিবাসী।
মূলত টিঅ্যান্ডটি বস্তিটি কড়াইল বস্তিরই একটি খণ্ডিত অংশ। টিঅ্যান্ডটি মাঠের পাশে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের জায়গা এটি। এই বস্তিসহ আশপাশের এলাকায় জাতীয় জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ৪৭ দশমিক ৮৮ একর, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ৩৫ একরসহ অন্যান্য জমিতে সাতটি প্রতিষ্ঠানের ভবন ওঠার কথা থাকলেও জায়গা বেদখল হওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না।
শনিবারের আগুনে এই বস্তির অন্তত ৩০০ ঘর পুড়ে গেছে। বস্তির মানুষ আগুন লাগার সঠিক কারণ বলতে পারেন না। অন্যদিকে এখনো প্রতিবেদন দেয়নি ফায়ার সার্ভিস। পুরো ঘটনা এখনো তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে। আর খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোর বাসিন্দারা।
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ঢাকা মেট্রো) দেবাশীষ বর্ধন সারাবাংলাকে বলেন, বস্তিতে লোহার পাইপ ও প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়া ছিল। প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন, ওই গ্যাস সংযোগ লাইন থেকেই আগুনের সূত্রপাত। তবে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মোস্তফা জামাল জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে প্রত্যেককে ২ হাজার টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে ঘর তৈরি বাবদ ৫ হাজার টাকা, নারীদের শাড়ি, পুরুষদের লুঙ্গি আর প্রতি ঘরে একটি করে কম্বলও দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে স্থানীয় কাউন্সিলরের পক্ষ থেকে তিন দিন খাবার দেওয়া হয়েছে।