৩ মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ২২ হাজার কোটি টাকা!
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২১:৫৯ | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২২:০৯
ঢাকা: ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের মাথায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এসে সেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এই তিন মাসের ব্যবধানে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে ২১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা! শুধু তাই নয়, খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় একবছর আগের অবস্থানে চলে এসেছে।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। তবে খেলাপি ঋণের এই তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
এর আগে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মার্চ শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকায়। একই বছরের জুন শেষে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা ও সেপ্টেম্বর শেষে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা ছিল খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অথচ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে এই ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) ২২ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বাড়লেও শেষ তিন মাসেই (সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ কমেছে ২১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা।
আচমকা খেলাপি ঋণ কমে যাওয়ার এই চিত্র কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপিদের নানা ধরনের ‘অনৈতিক’ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এতে করে প্রকৃত চিত্র আড়াল হয়ে গেছে। বিশেষ করে গণছাড়ের আওতায় শীর্ষ ঋণ খেলাপিরা পুনঃতফসিল করেছেন বলেই অঙ্কটি এত কম দেখাচ্ছে।
এর আগে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে খেলাপি আইন শিথিল, ঋণ অবলোপন নীতিমালায় ছাড়, স্বল্প সুদের ঋণের ব্যবস্থাসহ নানা ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কমে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, গত কয়েক মাসে অনেক ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। সেটা যোগ না করে একটা ‘রং পিকচার’ দেখানো হয়েছে। ফলে প্রকাশিত খেলাপি ঋণের তথ্য আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে। এটা করলে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ থেকে বের হয়ে যায়। এতে করে তাদের প্রভিশন রাখতে হয় না। তখন তাদের তারল্য প্রবাহ বেড়ে যায়। যদিও এগুলো ভুল পদক্ষেপ। এটি একটি মেথলজিক্যাল সমস্যা। যে পদ্ধতিতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হিসাব করা হয়, এই পদ্ধতিটাই সঠিক নয়।
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছিল, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, প্রধানত দুইটি কারণে ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে দেশে খেলাপি ঋণ কমেছে। প্রথমত, অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন দেশে খেলাপি ঋণ বাড়বে না। তার নির্দেশনা অনুয়ায়ী বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ উদ্ধারে বেশ তৎপর ছিল— এটি একটি কারণ।
দ্বিতীয় কারণ তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই মুখপাত্র বলেন, অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এ কারণেও বছর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। তবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন) খেলাপি ঋণ বাড়লেও তা প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় অনেক কম ছিল। দ্বিতীয় এই প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। তৃতীয় প্রান্তিকেও (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত ছিল। এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ২০১৯ সালের প্রথম ৯ মাসে ২২ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর মধ্যে বছরের প্রথম প্রান্তিকে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
তবে বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণের পরিমাণ যেমন রাতারাতি কমেছে, তেমনি কমেছে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপির শতকরা হারও। এই প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমেছে ২১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকার। আর এ সময়ে বিতরণ করা ঋণের মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ।