তাপমাত্রার সঙ্গে করোনা সম্পৃক্ততার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২১:৩৪
ঢাকা: বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে করোনাভাইরাস (কভিড-১৯)। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ২৮টি দেশে ছড়িয়েছে এই ভাইরাসের সংক্রমণ। বাড়ছে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছে, তখন অনেকেই এমন বলছেন— উষ্ণ তাপমাত্রায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এই তালিকায় বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী থেকে শুরু করে আছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পও। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে এমন তথ্য। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উষ্ণ তাপমাত্রায় করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি না থাকার তথ্যটির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউজে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নরদের সঙ্গে এক বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, আসছে এপ্রিলের গরমে কেটে যাবে করোনাভাইরাস আতঙ্ক। এ ধরনের ভাইরাস সাধারণত অতিরিক্ত তাপের মধ্যে টিকে থাকতে পারে না।
এর মধ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের নিজ কক্ষে এক ব্রিফিংয়ে প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, ৩২ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় করোনাভাইরাস আপনা আপনি ধ্বংস হয়ে যায়। আগামী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে দেশের তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়ে যাবে। তাই এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই।
আরও পড়ুন- করোনা আক্রান্তের বেশি ঝুঁকিতে বয়স্ক, অসুস্থরা: গবেষণা
কেবল বাংলাদেশ নয়, একই ধরনের তথ্য ছড়িয়েছিল পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনেও। দেশটির অনলাইন নিউজ পোর্টাল র্যাপলার বলছে, সেখানেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বেশকিছু পোস্টে বলা হয়, করোনাভাইরাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় টিকতে পারে না। ফিলিপাইন উষ্ণমণ্ডলীয় দেশ হওয়ায় সেখানে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি একেবারেই কম।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাস যে কেবল শীতপ্রধান ও শুষ্ক এলাকায় ছড়াবে, এমন নয়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতেও এর সংক্রমণের ঝুঁকি কোনোভাবেই কম নয়। আবহাওয়ার দিকে না তাকিয়ে নির্দেশনা মেনে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো থেকে বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বলছে, পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এরই মধ্যে ফিলিপাইনে তিন জন, সিংগাপুরে ৫৮ জন, মালয়েশিয়ায় ১৮ জন ও আরব আমিরাতে আট জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এই সবগুলো দেশেরই বিভিন্ন অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা এখন সর্বোচ্চ ২৮ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উষ্ণ তাপমাত্রা করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমাবে— এই তথ্যও তা প্রমাণ করছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, তাপমাত্রার সঙ্গে করোনাভাইরাসের সম্পৃক্ততা খোঁজার চেষ্টা হাস্যকর। সিঙ্গাপুরের তাপমাত্রা কি আমাদের চেয়ে বেশি? বিষুবরেখার খুব কাছে হওয়ায় দেশটিতে সবসময় গরমই থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো উষ্ণ। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতেও তো এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। আর যে চীনে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে, সেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কিন্তু গরম চলছে। সেখানেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গেছে। এসব এলাকায় যদি এই ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে, তবে আমাদের দেশে তার ঝুঁকি থাকবে না— এটা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য।
মুশতাক হোসেন বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে— করোনাভাইরাস একটি নতুন ভাইরাস, যা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এর কোনো গতিপ্রকৃতি বা বৈজ্ঞানিক তথ্য এখনো সম্পূর্ণভাবে কেউ জানাতে পারেননি। আর তাই এর সঙ্গে তাপমাত্রার সম্পর্ক নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ডা. কামরুল হাসান খান সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাসের সঙ্গে তাপমাত্রার সম্পর্ক যেভাবে বলা হচ্ছে, তা পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক নয়। ঠান্ডা আবহাওয়া বা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে, এটা ঠিক। তবে গরমে যে তার ঝুঁকি থাকে না, এটা বলার সুযোগ নেই।
ডা. কামরুল বলেন, অনেকেই বলছেন, এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও নাকি বলেছেন যে গরম এলে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি কমবে। কিন্তু এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বিশেষ করে করোনাভাইরাস নিয়ে এ সম্পর্কিত গবেষণাই তো হয়নি। ফলে এটি বলার সুযোগ নেই।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বিএসএমএমইউয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী সারাবাংলাকে বলেন, যেকোনো ভাইরাসের কিছু গতিপ্রকৃতি থাকে। যেহেতু করোনাভাইরাস সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাইরাস, তাই এর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে এখনো তেমন গবেষণালব্ধ ফল আমরা দেখিনি। ফলে তাপমাত্রার সঙ্গে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্পর্ক নিয়েও কিছু বলার সুযোগ নেই। গরম এলে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, এই তথ্যটিকেও তাই সঠিক বলা যায় না।
একই কথা বললেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাও। তিনি জানান, ৩২ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় করোনাভাইরাস নিজেই মারা যায়— এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। বরং করোনাভাইরাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রায়ও বেঁচে থাকতে পারে— এমন তথ্যই রয়েছে তাদের কাছে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য আমাদের জানাননি যে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। তাই এ ধরনের তথ্য সম্পূর্ণ বিভ্রান্তমূলক, যা মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাতে পারে।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছেন সে দেশের বিজ্ঞানীরাই। টেক্সাসের বেলর কলেজ অব মেডিসিনের ন্যাশনাল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের ডিন ড. পিটার হোটেজ বলেছেন, বসন্ত বা গ্রীষ্মের সময় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেমে যাবে— এটি মেনে নেওয়াটা হবে খামখেয়ালি। ঋতুভিত্তিক বিষয়টি এখানে ঠিক প্রযোজ্য নয়।
ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. উইলিয়াম শ্যাফনার বলেন, তার (ট্রাম্প) আশাই আমাদের আশা। তবে সেই আশার পক্ষে আমাদের কাছে কোনো জ্ঞান নেই।