Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া


২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২৩:৪৭

ব্রিটিশরা দুইশ বছর ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসনের নামে শোষণ করেছে। তাদের শোষণের প্রধান হাতিয়ার ছিল ডিভাইড অ্যান্ড রুল। মানে ভাগ কর আর শাসন কর। ১৯৪৭ সালে ফিরে যাওয়ার আগেও তারা ডিভাইডের শেষ আঘাতটা দিয়ে ভাগ করে যায় ভারতকে। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন হয় পাকিস্তান ও ভারত। তারপর ৭২ বছর ধরে পাশাপাশি চলছে দুই শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত। ধর্মকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বেড়ে ওঠা পাকিস্তান এখন বিশ্বে ব্যর্থ রাষ্ট্রের উদাহরণ।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানের চেয়ে একদিনের ছোট ভারত বেড়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ও অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। ভারতে সাম্প্রদায়িকতা একেবারেই ছিল না তা বলা যাবে না। বরং অপশক্তিরা বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক সস্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারপরও ভারত দাঁড়িয়েছিল বহুত্ববাদে, ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল তাদের ভিত। ভারতের এখনকার শাসকেরা সেই আত্মাকেই ধ্বংস করার পণ নিয়ে মাঠে নেমেছেন।

বিজ্ঞাপন

বিজেপি আগেও ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তখন তারা ভারতের মৌলিক চেতনায় আঘাত করেনি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহর অশুভ জুটি ভারতকে ধ্বংস করতে মাঠে নেমেছেন। এই অশুভ জুটির পথচলা অনেক পুরোনো। নরেন্দ্র মোদিকে বলা হয়, গুজরাটের কসাই। কারণ স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল গুজরাটে। ২০০২ সালের সে দাঙ্গায় ২ হাজারেরও বেশি মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এই নরেন্দ্র মোদি, তার উসকানিতেই ফ্যানাটিক পান্ডারা নির্বিচারে মুসলমানদের মারতে পেরেছিল। সে কারণেই তার উপাধি, গুজরাটের কসাই। সেই কসাই আজ দিল্লির মসনদে। আর তার সব অপকর্মের দোসর অমিত শাহ। এই অমিত শাহ এখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী; ২০০২ সালের দাঙ্গার সময় তিনি ছিলেন গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আশা করি মোদি-অমিত জুটির অশুভ ক্ষমতা নিয়ে আপনাদের কারও কোনো সন্দেহ থাকবে না। দিল্লিতে যা হয়েছে তা দুঃখজনক, বেদনাদায়ক, সভ্যতার জন্য কলঙ্ক; কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। গুজরাটের কসাই মোদির কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করিনি আমি। আম গাছে কখনও কাঁঠাল হয় না। মোদি-অমিত শাহ জুটি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে হত্যা করেছে অনেক আগেই, এখন চলছে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।

নরেন্দ্র মোদি যখন ২০১৪ সালের ভারতের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখনই আমি ভয়টা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রথম দফায় নিজেকে বদলে ফেলার ভান করেছিলেন মোদি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো বড় দায়িত্ব পেয়ে নিজের ভুলগুলো শুধরে নিজেকে আরও বড় করে তোলার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি এটা মুখোশমাত্র। সিংহের মুখোশ পড়লেও শেয়াল শেয়ালই থাকে। প্রথম দফার ভালোমানুষি ছিল আসলে তার প্রস্তুতি, ভারতকে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রস্তুতি।

সাধারণত বিরোধীদল সরকারকে বিব্রত করতে দেশে সংঘাত সৃষ্টি করতে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। কিন্তু কোনো সরকার যে জেনেশুনে, ইচ্ছা করে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে মোদি সরকারকে না দেখলে আমি বুঝতাম না। ৭২ বছর ধরেই বিশেষ মর্যাদা নিয়ে মুসলমান অধ্যুষিত কাশ্মির ভারতের সঙ্গে ছিল। কিন্তু মোদি সংবিধান সংশোধন করে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেন। কাশ্মির ও লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানিয়ে দেন। কাশ্মির নিয়ে ভারতের সুশীল সমাজ প্রতিবাদ করলেও রাজপথে তেমন প্রতিরোধ হয়নি। তাতেই লাই পেয়ে যান মোদি-অমিত জুটি।

নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের অবশ্য একটু ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। মোদি প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে নাগরিক পঞ্জি করার উদ্যোগ নেন। তাতে বহিরাগতদের চিহ্নিত করে ভারত থেকে বের করে দেওয়া বা ডিটেনশন ক্যাম্পের রাখার চেষ্টা হয়। নরেন্দ্র মোদির এই নাগরিক পঞ্জিতে ঠাঁই পাননি বংশ পরম্পরায় ভারতীয় অনেকেও। মোদি সরকারের মূল টার্গেট ছিল বাংলাভাষী মুসলমানরা। কোনোভাবে এদের কোণঠাসা করে তালিকার বাইরে রাখতে পারলে পরে সুযোগ বুঝে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া যাবে। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি, বাংলাদেশকে বারবার আশ্বস্ত করেছে; কিন্তু মোদির সব অপকর্মের দোসর অমিত শাহ অত ডিপ্লোম্যাসির ধার ধারেননি। চিহ্নিত করা ‘বাংলাদেশি’দের ফেরত পাঠানো ছিল তার নির্বাচনি অঙ্গীকার। কিন্তু সমস্যা হলো নাগরিকপঞ্জি করতে গিয়ে দেখা গেল, একটা বড় সংখ্যার হিন্দুও তালিকার বাইরে থেকে যাচ্ছে। যেটা আবার মোদি-অমিত জুটির রাজনীতির উল্টো।

এবার এলো ষড়যন্ত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়। নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বলা হলো, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে নির্যাতনের শিকার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও জৈনরা ভারতে গেলে ভারত তাদের বুকে টেনে নেবে; নাগরিকত্ব দেবে। এবার পরিষ্কার হলো তো মোদি-অমিতের আসল খেলা। হাতিকে যেমন কোণঠাসা করে করে খেদায় ঢোকানো হয়; ভারতের মুসলমানদের, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের তেমনি কোণঠাসা করে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে আসা এবং সুযোগ বুঝে সীমান্তের ওপাড়ে ঠেলে দেওয়াই হলো চূড়ান্ত লক্ষ্য। এখানে সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, দর্শনটা দেখুন। বহুত্ববাদের সৌন্দর্য্য দূরে ঠেলে ভারতকে একটি হিন্দু মৌলবাদী রাষ্ট্র বানানো। আরও সহজ করে বললে ‘হিন্দু পাকিস্তান’ বানানো। এটাই নরেন্দ্র মোদির সারাজীবনের রাজনীতি, সারাজীবনের দর্শন। দেশ গোল্লায় যাক, তাতে তার কিছু যায় আসে না।

তবে এবার নরেন্দ্র মোদির হিসাবে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। ভারতকে যারা ভালোবাসে, যারা মনে করে ধর্মনিরপেক্ষতাতেই ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব, যাদের বিবেচনায় উন্নয়ন মানে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া; তারা সবাই প্রতিবাদ করেছেন, মাঠে নেমেছেন। ভারতের নানান প্রান্তে জ্বলে উঠেছে প্রতিবাদের আগুন। সেই প্রতিবাদে শুধু মুসলমানরা নন, শামিল হয়েছেন সব ধর্ম, পেশার মানুষ। কারণ ধর্মকে নাগরিকত্বের মানদণ্ড করা স্পষ্টতই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের লঙ্ঘন। বরাবরের মত মোদি সরকার গায়ের জোরে ভিন্ন মতকে দমন করার চেষ্টা করেছে, ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে। কিন্তু এবার সত্যি হিসেবে গোলমাল হয়ে গেছে। নাগরিকত্ব বিল পাসের পর থেকে দিল্লির শাহীনবাগে রাস্তা বন্ধ করে প্রতিবাদ চলছিল। প্রথমে মোদি সরকার শাহীনবাগকে সন্ত্রাসীদের আখড়া আখ্যায়িত করে বিধানসভার নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানে ভরাডুবির পর আটে নতুন ষড়যন্ত্র। অনেকে বলছেন, এতদিন যে শাহীনবাগে বিক্ষোভ করতে দেওয়া হলো, সেটাও তো মোদি সরকারের সহনশীলতার প্রমাণ। কিন্তু এখন স্পষ্ট হলো, সেটা পরমতসহিষ্ণুতা নয়, বড় হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্যই এটা হয়েছে।

দিল্লিতে যা হয়েছে সেটা মোটেও নাগিরকত্ব আইনের পক্ষ-বিপক্ষ নয়, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নয়; এটা স্রেফ হত্যাকাণ্ড। বিজেপি তার ফ্যানাটিক পান্ডাদের লেলিয়ে দিয়ে বেছে বেছে মুসলমানদের হত্যা করেছে। অমিত শাহর পুলিশ হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে, নয় সহযোগিতা করেছে। বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে হামলার উসকানি দিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র সহায়তা করলে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নির্দেশ দিলে এই গেরুয়া বাহিনীকে আর কে ঠেকাবে। যে বিচারপতি উস্কানিদাতা বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন, তাকে রাতারাতি বদলি করা হয়েছে। একটা সরকার এতটা নির্লজ্জ, এতটা সহিংস, এতটা বেপরোয়া হতে পারে; এটা ভাবাও কঠিন। তবে মোদি-অমিত জুটির কাছে কিছুই অসম্ভব নয়।

অনেকে বলছেন, ভারতের জনগণ ভোট দিয়ে মোদিকে ক্ষমতায় এনেছে; তাই প্রায়শ্চিত্ত তাদেরই করতে হবে। এখানেই গণতন্ত্রের দুর্বলতা। মাত্র ৩৭ শতাংশ ভোটারের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছে। তার মানে ৬৩ ভাগ ভোটার তার বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন বাধ্য হয়ে সেই ৬৩ ভাগকেও মোদির উন্মাদনা মেনে নিতে হচ্ছে। কিন্তু ভারতীয়রা এবার মেনে নিচ্ছে না। তারা প্রতিবাদ করছে, প্রতিরোধ গড়ছে। ভারতের আত্মাকে বাঁচাতে ভারতের বিবেক জেগেছে। আমরা দেখেছি বহিরাগত পান্ডারা হামলা করলেও প্রতিবেশি হিন্দুরা মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছে, নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে মুসলমানদের বাঁচাচ্ছে। একতরফা হামলার পরও এইসব প্রতিরোধের গল্প আমাদের আশাবাদী করে। কাজী নজরুলের কথা মনে পড়ে-

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোন জন
হে, কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র’।

এই কথা বিজেপির পান্ডাদের কে বোঝাবে? তারপরও আশায় বুক বাঁধতে চাই। দিল্লিতেই চির অবসান ঘটুক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অমিত শাহ ধর্মনিরপেক্ষ ভারত মোদি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর