ধুলার ভারী প্রলেপে বন্দি রাজধানী
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৮:০৩
ঢাকা: গেল বছরের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় উল্লেখ করার মতো বৃষ্টিপাত হয়নি। যা একটু হয়েছে সেটিকে বৃষ্টি না বলে শিশিরপাত বললেও ভুল হবে না। ফলে রাজধানীকে ঢেকে রেখেছে ধুলার ভারী প্রলেপ। যাকে সাধারণ মানুষেরা ভাবছে ফাল্গুনের অকাল কুয়াশা!
সায়েদাবাদের জনপদ মোড়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছেন সৌরভ অধিকারী। তার মতে, ঢাকার সবচেয়ে ধুলা উড়ে শহরের এই প্রবেশ পথটিতে। সঙ্গে রয়েছে গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া। ফলে সারাদিন মাস্ক পরে কাজ করতে হয় তাকে।
সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কাছে ‘এই ধুলার মধ্যে মানুষ কিভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকবে?’ এমন প্রশ্ন ছুড়ে সৌরভ বলেন, ‘সারাদিন কী অবর্ণনীয় পরিশ্রম করি তা বলে বোঝানো যাবে না। এখানে ধোঁয়া আর ধুলার জন্য ঠিকমতো তাকানোও যায় না। আর শ্বাস নেওয়া তো ভয়ঙ্কর, ঠিকমতো কথাই বলতে পারি না। মুখ ভরে যায় ধুলায়। টানা হাঁচি-কাশি আসতে থাকে। কী এক অস্বস্থি নিয়ে কাজ করতে হয়। এসব ফেলে চলেও যাওয়া যায় না।’
সৌরভের বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে সায়েদাবাদ, জনপদ মোড় ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় সরেজমিন ঘুরে বেড়ান সারাবাংলার এই প্রতিবেদক। এসব এলাকার প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে তিনি কমপক্ষে কয়েক সেন্টিমিটার ধুলার আস্তরণ দেখা যায়। এছাড়াও বাতাসে ধোঁয়া ও ধুলার প্রলেপের কারণে এখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করা দায়।
সায়েদাবাদের পুরো বাসস্ট্যান্ড এলাকা ধুলায় সাদা হয়ে আছে। গাছের পাতা সবুজ নাকি কালো, এখানে এলে সেটিও নিশ্চিত করে বলতে পারবে না কেউ। এরমধ্যেই আবার পানি ও গ্যাসের সংযোগ মেরামতের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।
রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের জন্য ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়েছে রাজধানীর বুদ্ধিবৃত্তির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ এলাকাও। বইমেলায় ব্যাপক লোক সমাগম ও মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের জন্য এখানে উড়ন্ত বালুর পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেশি। ফলে এখানকার জমজমাট সাহিত্য আড্ডা এখন বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাদ চৌধুরী বলেন, ‘অপরিকল্পিত উন্নয়নের দায় মেটাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ধুলার কারণে আড্ডা ভাঙছে সেটি বড়ো কথা নয়, বিষয় হলো মানুষ কষ্ট করছে। তাদেরকে নানান অসুখেও ভুগতে হচ্ছে। এবং এটি কোনো আশার কথা নয়।’
কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী কিংবা গাবতলী নয়, রাজধানীর প্রতিটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় এখন ছড়িয়ে পড়েছে ধুলা আর কালো ধোঁয়ার দূষণ।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, ‘এটি শুষ্ক মৌসুম। স্বাভাবিকভাবেই এখন বাতাসে সূক্ষ্ম কণার মাত্রা বেড়ে গেছে। এই কণা ফুসফুস থেকে শ্বাসনালি পর্যন্ত আক্রান্ত করছে। যে কারণে কাশি, শ্বাসকষ্ট ও ইনফেকশনের মতো সমস্যা বাড়ছে। যাদের আগে থেকেই অ্যাজমা রয়েছে তাদের সমস্যা জটিল হচ্ছে। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড বেড়ে যাওয়ার ফলে ফুসফুসে ক্যানসারের সংক্রমণও বাড়ছে।
‘বায়ুদূষণের কারণে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত’ হচ্ছে জানিয়ে সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, ‘বাতাসে সীসার উপস্থিতি থাকায় শিশুদের স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশ হচ্ছে না। যেটি ভবিষ্যতে একটি বুদ্ধিহীন জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারে।’
ঢাকায় ধুলা বেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে গিয়ে জানা যায়, তারা নিজেরাও এ সমস্যার কারণে বিব্রত। এমনকি ধুলার হাত থেকে রেহাই পেতে করপোরেশনের চাকরিজীবীরা পর্যন্ত মাস্ক পরে অফিস করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দক্ষিণ ঢাকার সড়কে আমরা প্রতিদিন দুই বেলা পানি ছিটাই। যেসব রাস্তায় ধুলা বেশি সেখানে বেশি পানি ছিটানো হয়। কিন্তু তাতেও ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। আমরাও আক্রান্ত। এই যে দেখেন মাস্ক পরে কাজ করছি। কী করব?’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেও একই সমস্যায় ভুগছেন কর্মকর্তারা। সেখানে পানি ছিটানোর গাড়ির সংকট রয়েছে বলেও জানিয়েছেন একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা আবু নাসের খান ধুলা ও ধোঁয়া বৃদ্ধির পেছনে বেশকিছু বিষয়কে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করেছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘রাজধানীর চারপাশে ইটভাটায় নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার, যানবাহনেও নিম্নমানের জ্বালানি এবং অপরিকল্পিত নির্মাণ ও সংস্কারকাজের ফলে ঢাকার বায়ুমান চূড়ান্ত পর্যায়ে খারাপ হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এক রাস্তা দশবার খোঁড়া হয়। ওয়াসা, রাজউক, সিটি করপোরেশন, যার যখন ইচ্ছা এসে রাস্তা খুঁড়ে রেখে যায়। এতে ধোলা বাড়ে। বাতাস বিষাক্ত হয়। ভোগান্তি হয় সাধারণ মানুষের। বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। প্রায় সমান সংখ্যক মানুষকে ভুগতে হয় দুরারোগ্য ও জটিল বিভিন্ন রোগে।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ অ্যাফেক্টস ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণাপত্রের উদাহরণ দিয়ে আবু নাসের খান বলেন, ‘বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যান। একই সংখ্যক মানুষকে সারাবছর ধরে ভুগতে হয় ফুসফুসসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন জটিল রোগে। উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ, বুদ্ধিমত্তাবিহীন বা নির্বোধ শিশুর সংখ্যাও বেড়ে গেছে।’
হেলথ অ্যাফেক্টস ইনস্টিটিউটের গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে ঢাকার বায়ু সবসময় আদর্শ বায়ুমান এর চেয়ে চার থেকে ছয়গুণ বেশি খারাপ ছিল।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৬ বছরে (২০১৩-২০১৮) বায়ু দূষকগুলোর মধ্যে বিশেষ করে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ তুলনামূলক বেড়ে চলেছে। এ সময়ের শীতকালে বায়ু দূষণের মাত্রা জাতীয় আদর্শ বায়ুমানের ১১ দশমিক ৮০ গুণ বেশি ছিল এবং বর্ষাকালে আদর্শ বায়ুমানের প্রায় ২ গুণ বেশি ছিল।
শীতকালে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে প্রাকৃতিকভাবেই বায়ুদূষণ বছরের অন্যান্য সময় থেকে কম থাকে।
রাজধানীর ৭০টি স্থানের বায়ু পর্যবেক্ষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ১৩ মাসে ঢাকার মানুষ মাত্র ৯ দিন (২ শতাংশ) সময় ভালো বায়ু সেবন করেছে এবং ১৮৮ দিন (৪৮ শতাংশ) মধ্যম থেকে সতর্কতামূলক দূষিত বায়ু সেবন করেছে, ১০৭ দিন (২৮ শতাংশ) অস্বাস্থ্যকর বায়ু, ৮২ দিন (২১ শতাংশ) খুবই অস্বাস্থ্যকর বায়ু এবং ৫ দিন (১ শতাংশ) মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর বায়ু সেবন করেছে।
ক্যাপস বলছে, ঢাকা শহরের মধ্যে এলাকাভেদে দূষণের কম বেশি আছে। ঢাকার সবচেয়ে দূষিত এলাকা এখন পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ফার্মগেট। এরপরেই যথাক্রমে দূষণের শীর্ষ সারিতে রয়েছে পুরান ঢাকার ইংলিশ রোড, সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডির শংকর, নয়াপল্টন ও হাজারীবাগ এলাকা। তুলনামূলকভাবে বায়ুর মান ভালো পাওয়া গেছে মানিকদী ও গুলশান এলাকায়।
ঢাকার দূষণের ইটভাটা ৫৮ শতাংশ, সড়কের ধুলা ১৮ শতাংশ, যানবাহনের ধোঁয়া ১০ শতাংশ, বায়োগ্যাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণ ৬ শতাংশ দায়ী বলেও জানিয়েছে ক্যাপস।
২০১৯ সালে বায়ু দূষণের পরিমাণ ২০১৮ সাল হতে গড়ে প্রায় ২০% বেড়েছে। ফলে শিশু মৃত্যুর হারে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে পৌঁছে গেছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহমেদ বলেন, ‘রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা কমাতে কাজ করে যাচ্ছি। দূষণ কমাতে আমরা জেল-জরিমানা পর্যন্ত করছি, কিন্তু দূষণ কমছে না। ঢাকার বিষাক্ত বাতাসকে নির্মল করতে হলে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে, নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে।’
এদিকে বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় আজকেও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে ঢাকা।
শনিবার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ২১৫, মানে বাতাসের মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। একিউআই মান ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।