ঢাকা: চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে উৎপত্তি হয়ে এখন বিশ্বের ৭৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের সব দেশই এখন এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর প্রভাব ক্রীড়াঙ্গনেও পড়েছে বেশ ভালোভাবেই। চাইনিজ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন চলতি বছরের ঘরোয়া ফুটবল মৌসুম অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল ঘোষণা করেছে। ইউরোপে ছয়টি দেশের রাগবি চ্যাম্পিয়নশিপ স্থগিত করা হয়েছে। ইতালিতে জুভেন্টাস ও এসি মিলানের মধ্যেকার ইতালিয়ান কাপের সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচটি স্থগিত করা হয়েছে। করোনা আতঙ্কে হুমকির মুখে টোকিও অলিম্পিকও।
ঠিক এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফরের তৃতীয় ধাপ নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। কারণ এরই মধ্যে দেশটিতে পাঁচ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন দেশটির কর্তৃপক্ষ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে একদিকে যখন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিদেশ ভ্রমণে সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পরও টাইগার টিমের পাকিস্তান সফর কতটা নিরাপদ হবে— তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। সবার মনেই প্রশ্ন, জাতীয় ক্রিকেট দলকে কি পাকিস্তানে পাঠানো হবে?
টিম টাইগারকে ঘিরে এমন ঝুঁকির আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে আসা মানেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হওয়া। পাকিস্তানে পাঁচ জনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় তথ্যে তাই শঙ্কিত না হওয়ার কারণ নেই। শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে করাচি ও বেলুচিস্তানের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় দফা বন্ধ করার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। তার ওপর দেশটির করাচিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সবশেষ রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। আর বাংলাদেশ দলের পাকিস্তান সফরের তৃতীয় এই পর্বের ভেন্যুও সেই করাচিই!
এর আগে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে আইইডিসিআর সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী রয়েছে— এমন কোনো দেশে যেন কেউ বাংলাদেশ থেকে না যান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও এক অনুষ্ঠানে বিদেশ সফরে নিরুৎসাহিত করেছেন সবাইকে।
জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সারাবাংলাকে বলেন, যারা দেশের বাইরে যাচ্ছেন, বিশেষ করে করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশে, তাদের নিরুৎসাহিত করছি। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ— আমরা এখন পর্যন্ত সেই দেশগুলোকে আক্রান্ত (অ্যাফেক্টেড) বলছি, যেখানে লোকাল ট্রান্সমিশন হচ্ছে। পাকিস্তানে লোকাল ট্রান্সমিশন আছে কি না, তা আমরা এখনো জানি না। তবে তারা যদি বলেও যে তাদের লোকাল ট্রান্সমিশন নেই, সেটিও সরাসরি মেনে নেওয়া যায় না। কারণ তারাও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। আবার এখন লোকাল ট্রান্সমিশন না থাকলেও যে ভবিষ্যতেও থাকবে না, সেটা বলা যায় না।
অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, সেক্ষেত্রে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি কোনো দেশের নাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আক্রান্ত দেশগুলোর তালিকায় না আসে, সেক্ষেত্রেও আমরা পর্যবেক্ষণ করে যাব।
আইইডিসিআর পরিচালক আরও বলেন, আরেকটি কনসার্নের বিষয় হলো বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দর। দেখা গেল গন্তব্য দেশে করোনাভাইরাস নেই। কিন্তু যাওয়ার সময় হয়তো অন্য একটি দেশে ট্রানজিট হয়েছে। সেখানে অনেক দেশেরই ফ্লাইট থামবে। ওখানে দুই থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত অবস্থান করতে হতে পারে। অনেকে এই সময় হোটেলেও অবস্থান করেন। এ ক্ষেত্রে ভ্রমণকারীর পাশের জন যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। বিমানবন্দর সবচেয়ে কমন ট্রান্সমিশন এলাকা হওয়ায় ঝুঁকির অবকাশ থাকে। আর সরাসরি গন্তব্য দেশে ফ্লাইট থাকলে সে ঝুঁকি কিছুটা কমেও আসে।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফরের বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নেবে বলেই আশাবাদ জানান আইইডিসিআর পরিচালক ডা. ফ্লোরা।
এ পরিস্থিতিতে বিসিবি কী ভাবছে— জানতে চাইলে বিসিবি’র মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমাম সারাবাংলাকে বলেন, ক্রিকেটারদের জন্যে বোর্ডের কনসার্ন সবসময়ই সবার চেয়ে বেশি। আমাদের বোর্ডের সঙ্গে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। সময় তো এখনো অনেক আছে। নিশ্চয়ই এ বিষয়ে কথা হবে। যদি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক হয়ে থাকে, সেটা বুঝেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বোর্ড।
রাবিদ ইমাম আরও বলেন, যেহেতু যেকোনো দেশেই যাওয়ার বিষয়ে একটি সতর্কতা থাকে, তাই ক্রিকেট বোর্ডও বিষয়টি খেলোয়াড়দের দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে। এ বিষয়ে পিসিবি’র সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বে থাকা বিসিবি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিজামুদ্দিন চৌধুরী সুজনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
জানতে চাইলে নিজামুদ্দিন চৌধুরী সুজন সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাস এখন কেবল আমাদের নয়, বিশ্বব্যাপী কনসার্নের একটি বিষয়। আমরা সেদিকে নজর রাখছি। একইসঙ্গে যেহেতু সফরটি আরও পরে, তাই এখন আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি, সামনের দিনগুলোতেও পর্যবেক্ষণে রাখব। এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যা যা আলোচনা করা দরকার, তা করা হবে। সফর যেহেতু আরও পরে, তাই আমরা সেই সময়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারব।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিষয়টি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করছেন তিনি।
এ বিষয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহ্সান রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, পাকিস্তান যখন তাদের নিরাপত্তার দিক নিশ্চিত করে, এরপর আমরা আমাদের ক্রিকেট দলকে সেখানে খেলতে পাঠাই। আমাদের কাছে সবসময় ক্রিকেটারদের নিরাপত্তাই মুখ্য। এই সময়ে করোনাভাইরাস অত্যন্ত উদ্বেগজনক একটি বিষয়। সেখানে যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণ আরও ছড়ায়, সেক্ষেত্রে আমাদের নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
প্রতিমন্ত্রী রাসেল আরও বলেন, পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ ছিল। তারা সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু করোনাভাইরাস যেনতেন রোগ নয়। এই রোগ একজনের থেকে অন্য জনে ছড়ায়। এ অবস্থায় আমরা আমাদের খেলোয়াড়দের হুমকির মুখে ফেলতে পারি না। আমরা সব ধরনের ক্লিয়ারেন্স পেলেই সফরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করব। আর সফরের আগে এখনো সময় হাতে আছে। ফলে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ নেই। আমরা সফরের আগে আবার বসে সিদ্ধান্ত নেব।
এর আগে, দীর্ঘ আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত গত ১৪ জানুয়ারি তিন ধাপে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফরের বিষয়ে সমঝোতায় আসে বিসিবি ও পিসিবি। এরই মধ্যে প্রথম দুই ধাপের সফর শেষ হয়েছে। তৃতীয় ধাপের সফরে আগামী ২৯ মার্চ পাকিস্তান যাওয়ার কথা রয়েছে টাইগারদের। সফরে আগামী ৩ এপ্রিল সিরিজের একমাত্র ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। আর ৫ এপ্রিল থেকে অনুষ্ঠিত হবে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের শেষ টেস্টটি। দুইটি ম্যাচই অনুষ্ঠিত হবে করাচির জাতীয় স্টেডিয়ামে।