চাপ-অনুরোধ উপেক্ষা করে রয়েই গেলেন আ.লীগের অধিকাংশ বিদ্রোহী
৮ মার্চ ২০২০ ২১:৩৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের আহ্বান-অনুরোধ, হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ ওয়ার্ডেই প্রার্থী হিসেবে রয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। বিশেষ করে বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে যারা মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছিলেন তাদের কেউই প্রত্যাহার করেননি। তবে বিদ্রোহীদের মধ্যে আলোচিত কয়েকজন সরে দাঁড়িয়েছেন।
নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের মতে, শেষ মুহূর্তে বিদ্রোহীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃশ্যমান জোরালো ভূমিকা ছিল না। তারা বরং সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়েছিলেন। এছাড়া চট্টগ্রামে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রক নেতা যারা তাদের কয়েকজনের ভূমিকাও ছিল রহস্যজনক। দৃশ্যমান চাপ না থাকায় বিদ্রোহীরা মাঠ ছেড়ে যাননি।
রোববার (৮ মার্চ) মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিনে সাধারণ কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহী ৫০ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ২ জন মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। প্রত্যাহারের পর এখন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাধারণ একটি ওয়ার্ডে একক প্রার্থী আছেন। বাকি ৪০টি ওয়ার্ডে ১৬১ জন এবং সংরক্ষিত ১৪টি ওয়ার্ডে ৫৬ জন ভোটের লড়াইয়ে আছেন।
ঘোষিত তালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের পর পাঁচটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী আছেন। এরা হচ্ছেন- ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডে আশরাফুল আলম, ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডে শৈবাল দাশ সুমন, ২৩ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডে মোহাম্মদ জাবেদ, ৩৫ নম্বর বকশিরহাট ওয়ার্ডে হাজী নুরুল হক, ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডে জিয়াউল হক সুমন।
১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের হারুনুর রশিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন আজিজুল হক মাসুম। রোববার মাসুম মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এর ফলে হারুনুর রশিদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার অপেক্ষায় আছেন।
আওয়ামী লীগ বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে সাধারণ ওয়ার্ডে ১৪ জন এবং সংরক্ষিত পদে পাঁচ জনসহ ১৯ জনকে সমর্থন না দিয়ে নতুন প্রার্থী দিয়েছে। এদের মধ্যে সাধারণ ওয়ার্ডে ১২ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডে পাঁচ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়ে গেছেন।
বিদ্রোহী বর্তমান কাউন্সিলররা হলেন- ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর তৌফিক আহমেদ চৌধুরী, ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডের সাহেদ ইকবাল বাবু, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জহুরুল আলম জসীম, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের মোরশেদ আক্তার চৌধুরী, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে সাবের আহমেদ, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর এফ কবির মানিক, ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডের এস এম এরশাদ উল্লাহ, ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের এইচ এম সোহেল, ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডে আব্দুল কাদের ওরফে মাছ কাদের, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে তারেক সোলায়মান সেলিম, ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ডের হাসান মুরাদ বিপ্লব ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের মাজাহারুল ইসলাম চৌধুরী।
এদের মধ্যে তৌফিক আহমেদ চৌধুরী প্রয়াত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। বর্তমানে নিজেকে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন। সাহেদ ইকবাল বাবু, এস এম এরশাদ উল্লাহ, এইচ এম সোহেল, আব্দুল কাদের ওরফে মাছ কাদের ও হাসান মুরাদ বিপ্লব নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সাবের আহমেদ ও এফ কবির আহমেদ মানিক সাবেক মন্ত্রী আফছারুল আমিনের অনুসারী। জহুরুল আলম জসীম, মোরশেদ আক্তার চৌধুরী, তারেক সোলায়মান সেলিম নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনের অনুসারী। তবে তারা মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনেরও ঘনিষ্ঠ। মাজাহারুল ইসলাম চৌধুরী সংসদ সদস্য এম এ লতিফের অনুসারী।
সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়ে গেছেন, তারা হলেন- ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে জেসমিন পারভীন জেসি, ৯, ১০ ও ১৩ নম্বর পদে আবিদা আজাদ, ১৬, ২০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে আনজুমান আরা বেগম, ১২, ২৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ফারহানা জাবেদ এবং ২৮, ২৯ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে ফেরদৌসি আকবর।
তবে তিনটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলরদের প্রার্থীতা বদলের তথ্য পাওয়া গেছে।
এরমধ্যে ৩ নম্বর সংরক্ষিত (৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড) আসনে জোহরা বেগমের পরিবর্তে বর্তমান কাউন্সিলর জেসমিন পারভীন জেসি মনোনয়ন পেয়েছেন। ৫ নম্বর সংরক্ষিত (১৪, ১৫, ২১) ওয়ার্ডে আনজুমান আরা দলীয় প্রার্থী করা হয়েছে। এরআগে এই পদে শিউলি দে নামের একজনকে মনোনয়ন দেয়া হয়। নির্ধারিত বয়সের কম হওয়ায় শিউলি দে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। ১১ নম্বর সংরক্ষিত (২৮, ২৯, ৩৬) ওয়ার্ডে শুরুতে আওয়ামী লীগ জিন্নাত আরাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। রোবাবার রাতে তা পরিবর্তন করে বর্তমান কাউন্সিলর ফেরদৌসি আকবরকে মনোনয়ন দেয়।
রোববার মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষদিনে নগরীর চান্দগাঁও, মোহরা, লালখান বাজার, উত্তর পাঠানটুলী, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের চারজন করে তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এছাড়া দক্ষিণ পাহাড়তলী, জালালাবাদ, চকবাজার, ফিরিঙ্গাবাজার ওয়ার্ডের দুজন করে প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। আর একজন করে প্রার্থী প্রত্যাহার করেছেন পাঁচলাইশ, পশ্চিম ষোলোশহর, শুলকবহর, পাহাড়তলী, বাগমনিরাম, পশ্চিম বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া, দেওয়ান বাজার, উত্তর হালিশহর, পাঠানটুলী, আন্দরকিল্লা, পাথরঘাটা, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর, দক্ষিণ হালিশহর, উত্তর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রার্থীতা প্রত্যাহার হয়েছে জামালখান ওয়ার্ডে। সরে দাঁড়ানো ছয়জন হলেন- এবারের প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের ভাই রাজীব দাশ সুজয়, সাবেক কাউন্সিলর এম এ নাসের ও বিজয় কিষাণ চৌধুরী, ফরহাদুল ইসলাম রিন্টু, আবদুল হান্নান ও সুচিত্রা গুহ।
এছাড়া ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তৌফিক আজিজ প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন। ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ করিম টিটু প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন। এছাড়া ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক খালেদ হোসেন খান ও নাজিম উদ্দিন চৌধুরী এবং জানে আলম জিকু প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন। ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এ কে এম জাবেদুল আলম সুমন প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে গত ৫ মার্চ সমঝোতা বৈঠক করেছিলেন চসিক নির্বাচনে সমন্বয়ের দায়িত্ব পাওয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনড় ভূমিকার কারণে বৈঠক ভেস্তে যায়। এরপর শনিবার রাতে মোশাররফ আবারও বাসায় ডেকে বিদ্রোহীদের প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেন। মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং আ জ ম নাছির উদ্দীনও প্রার্থীতা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
এরপর রোববার কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এসে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে বিকেলে মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়ার মাত্র আধাঘণ্টা আগে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বিদ্রোহীদের কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করেন। এর মধ্যেই প্রার্থীতা প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়ে যায়।
নগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নানামুখী চাপের কারণে অনেক বিদ্রোহীই প্রার্থীতা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে তারা দ্বন্দ্বে পড়ে যান এবং অপেক্ষা করতে থাকেন। মাহবুবুল আলম হানিফের বক্তব্যে তারা হতাশ হয়ে প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেন। কিন্তু এর মধ্যেই সময় শেষ হয়ে যায়।’
নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের কঠোর বক্তব্যের কারণে বিদ্রোহীদের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আনুষ্ঠানিক প্রত্যাহার না করলেও আমার মনে হচ্ছে, অনেকে দলীয়ভাবে প্রত্যাহার করবেন। সব মিলিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবেই নির্বাচন করতে পারব বলে আশা রাখি।’