‘ঝুঁকির’ চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষা চলছে ‘নামকাওয়াস্তে’
৯ মার্চ ২০২০ ২২:৩১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বন্দর এবং শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেই কোনো থার্মাল স্ক্যানার। অথচ দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশ থেকে আসা নাবিক ও যাত্রীদের কারণে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সবচেয়ে বেশি করোনা ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকির মধ্যে আছে।
দুটি বন্দরে নাবিক ও যাত্রীদের স্বাস্থ্য বিভাগের টিম ‘ইনফ্রায়েড থার্মোমিটার’ এবং ‘সাধারণ থার্মোমিটার’ দিয়েই ভাইরাস ও অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি পরীক্ষা করছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১১ সদস্যের কমিটি করা হলেও তাদের কার্যক্রম এখনও ‘কাগজে-কলমেই’ সীমাবদ্ধ।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরে যাত্রী ও নাবিক মিলিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে এদের মধ্যে কারও শরীরে জ্বরের উপসর্গ পাওয়া যায়নি। কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর মতোও কাউকে পাওয়া যায়নি। এরপরও ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত ছয়টি দেশ থেকে আসা লোকজনের নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিভিল সার্জন পদমর্যাদার চট্টগ্রাম বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদমর্যাদার অফিসারের অধীনে আমাদের আলাদা-আলাদা টিম চট্টগ্রাম বন্দর ও শাহ আমানত বিমান বন্দরে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছে। তাদের সঙ্গে স্যানিটারি ইনসপেকটর-নার্স আছেন। আমরা এ পর্যন্ত বিমানবন্দরে ৪০ হাজার ৩৯১ জনকে পরীক্ষা করেছি। সমুদ্রবন্দরে ৪ হাজার ৫০০ জনকে পরীক্ষা করেছি।’
থার্মাল স্ক্যানারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার যেটি আছে, সেটি অনেক দিন ধরে নষ্ট। বন্দরে কোনো থার্মাল স্ক্যানার নেই। আমরা মূলত ইনফ্রায়েড থার্মোমিটার দিয়ে স্ক্রিনিং করছি। অন্তত ২টি থার্মাল স্ক্যানারের চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি। আমাদের বলা হয়েছে, ১৫-২০ দিনের মধ্যে একটি বিমানবন্দরে পৌঁছবে। সেটি স্থাপন করতে সাতদিন লাগবে।’
সূত্র মতে, গত ৩১ জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি জাহাজ এবং বিদেশ ঘুরে আসা দেশি জাহাজের নাবিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু হয়। প্রথম দিকে জাহাজ থেকে নেমে জেটিতে আসার পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছিল। কিন্তু মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় আসা জাহাজে গিয়েও নাবিকদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে চীনের জাহাজের নাবিকদেরই সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ শতভাগ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
নবর্বষের ছুটির পর চীন থেকে পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসা শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে প্রতিদিন গড়ে একটি পণ্যভর্তি চীনা জাহাজ আসছে। জেটিতে নোঙ্গরের পর জাহাজ থেকে নেমে বিদেশি নাবিক যারা চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করছেন তাদের শতভাগ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। বন্দর এক নম্বর গেইটে স্থাপন করা হয়েছে ইনফ্রায়েড থার্মোমিটার।
বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চীনের জাহাজের নাবিক যারা আছেন অথবা চীন থেকে যেসব জাহাজ আসছে, এর নাবিকদের শতভাগ স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরই আমরা শহরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছি। যদি কারও শরীরে জ্বর কিংবা এ সংক্রান্ত অন্য কোনো উপসর্গ পাওয়া না যায়, তাহলে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তবে গেইটে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় শুধু চীন নয়, সবদেশের নাগরিকদের পরীক্ষা করা হচ্ছে।’
সূত্রমতে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও গত ৩১ জানুয়ারি থেকেই বিদেশ ফেরত যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু হয়। তবে প্রথম দিকে শুধু চীন থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছিল। এখন সবাইকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ভাইরাসমুক্ত সনদ নিয়ে তারপর বিমানবন্দর ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত ৬টি দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ওপর বাড়তি নজর দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা। দেশগুলো হচ্ছে- চীন, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ইরান।
আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুট মিলিয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজারের মতো যাত্রী আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে দেড় হাজার আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রী। যে ছয়টি দেশের বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা আছে সেগুলোর সঙ্গে সরাসরি কোনো ফ্লাইট যোগাযোগ চট্টগ্রামের নেই। চট্টগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক সব ফ্লাইটই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটের। তবে কানেক্টিং ফ্লাইটে এসে ওইসব দেশের যাত্রীরাও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর পার হন। ইতালি থেকে সোমবার (৯ মার্চ) চারজন এবং রোববার তিনজন যাত্রী শাহ আমানত বিমানবন্দর হয়ে চট্টগ্রামে এসেছেন। পরীক্ষায় তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ না পেয়ে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে বিমানবন্দরে দায়িত্বরত সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এম জেড এ শরীফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সব যাত্রী, যে দেশ থেকেই আসুক না কেন, আমরা সবাইকে পরীক্ষা করছি। তবে চীন-ইতালি থেকে আসা যাত্রীদের আমরা বেশি জোর দিচ্ছি। যদিও তারা সরাসরি কোনো ফ্লাইটে আসছে না। তারপরও আমরা তাদের নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর রাখছি। যে এলাকার বাসিন্দা সেখানকার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে অবহিত করছি। তাদের বলা হচ্ছে, যদি শরীরে জ্বর আসে কিংবা এ ধরনের বিন্দুমাত্র কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।’
তবে স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শতভাগ স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা বলা হলেও বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরের কোথাও সেটা হচ্ছে না। এ জন্য তারা থার্মাল স্ক্যানার, পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স না থাকা এবং সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে চট্টগ্রাম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
এদিকে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত ১১ সদস্যের কমিটি গত ৪ মার্চ প্রথম বৈঠক করে নগরীর দুটি স্কুলকে কোয়ারেন্টাইনের জন্য নির্ধারণ করেছিল। গত প্রায় এক সপ্তাহেও স্কুল দুটি চূড়ান্ত করতে পারেনি কমিটি। সোমবার (১০ মার্চ) স্কুল দুটি পরিদর্শনে যাবেন বলে জানিয়েছেন কমিটির সদস্য সচিব চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী। করোনাভাইরাস নিয়ে চট্টগ্রামের জনগণকে সচেতন করতেও এ কমিটির দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি গত এক সপ্তাহেও।
এর আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের জরুরি চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঁচটি, ফৌজদারহাটে বিআইটিআইডিতে পাঁচটি করে শয্যা এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৪ শয্যা করে ৮ শয্যার ২টি কেবিন প্রস্তুত রাখার কথা বলেছিলেন চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
রোববার (৮ মার্চ) ইতালি থেকে আসা দুজনসহ তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভাগীয় শহরে ৩০০ থেকে ৩৫০ শয্যা এবং জেলা শহরে কমপক্ষে ১০০ শয্যা প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আসার পর ফৌজদারহাটে বিআইটিআইডিতে ৫০টি শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কেউ শনাক্ত হলে তাকে প্রথমেই সেখানে পাঠানো হবে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বন্দর হাসপাতালকে ১০০টি করে ২০০ শয্যা প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধীনে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৫০টি করে ১০০টি শয্যা প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ১৪টি উপজেলায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র মিলিয়ে আরও ১৫০ শয্যা প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে সিভিল সার্জন জানান।
চমেক হাসপাতালকে রিজার্ভ কেন্দ্র হিসেবে রাখা হচ্ছে জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, ‘আমরা তাদের আইসিইউ সুবিধা নেব। তাদেরকেও একটি ওয়ার্ড রেডি রাখতে বলেছি। সেখানে এত বেশি রোগী এবং এত জনসমাগম হয়, পারতপক্ষে আমরা সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কাউকে নেওয়ার পক্ষে নয়। তবে সব হাসপাতালেই আলাদা ওয়ার্ডে, একেবারে পৃথকভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা চলবে, যদি কাউকে পাওয়া যায়।’
সিভিল সার্জন আরও জানান, আপাতত হ্যান্ড হেল্ড থার্মোমিটার দিয়ে সব চিকিৎসা কেন্দ্রে পরীক্ষার প্রস্তুতি আছে। তবে খুব শীঘ্রই বিমানবন্দর ও সমুদ্র বন্দরের জন্য দুটি থার্মাল স্ক্যানার আসার সম্ভাবনা আছে।
তবে সিভিল সার্জন জানালেও চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে প্রস্তুতি তেমন দৃশ্যমান নয় বলেই জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা।
চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগে সোমবার (৯ মার্চ) পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ দশ হাজার ৪১ জন। ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাস আক্রান্ত ৬১ হাজার ৯৭৯ জন সেরে উঠে নিয়মিত জীবনে ফিরে গেছেন। সেই হিসেবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত অর্ধেকের বেশি রোগী সেরে ওঠার খবর জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন আপডেটের বরাতে জানিয়েছে নিউইয়র্ক পোস্ট।
এদিকে, করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশ ও মেইনল্যান্ডে ইতোমধ্যেই সেরে উঠেছেন ৪৬ হাজার ৪৩৩ জন। ইরানে আক্রান্তদের মধ্যে সেরে উঠেছেন ২ হাজার ১৩৪ জন। ইতালিতে সেরে উঠেছেন ৬২২ জন। জাপানে ৭৬ জন, হংকংয়ে ৫৯ জন, থাইল্যান্ডে ৩১ জন, মালয়েশিয়ায় ২৪ জন, জার্মানিতে ১৮ জন, যুক্তরাজ্যে ১৮ জন, ভিয়েতনামে ১৬ জন, তাইওয়ানে ১৫ জন, মিশরে ১২ জন, ম্যাকাওয়ে ১০ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ১৯ জন, ফ্রান্সে ১২ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৭ জন, বাহরাইনে ৪ জন, ভারতে ৩ জন, রোমানিয়ায় ৩ জন, কানাডায় ৭জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত সেরে উঠেছেন।
এদিকে এরইমধ্যে ৮ মার্চ বাংলাদেশ ১০৪তম দেশ হিসেবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের তালিকায় স্থান করে নিলো।