Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা রোধে লকডাউন: বিশ্ব পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ


২৮ মার্চ ২০২০ ২১:৪৩

পুরো দেশ লকডাউন করে দিলেই যে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) বিস্তার রোধ করা সম্ভব, তা অনেক দেশই প্রমাণ করেছে। চীনের উহানে এই ভাইরাস বিস্তারের খবর পাওয়া মাত্রই তাদেরই প্রতিবেশী রাষ্ট্র রাশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া পুরো দেশ লকডাউন করে দিয়েছে। ফলে দেশগুলোতে সেভাবে করোনা বিস্তার লাভ করতে পারেনি।

বর্তমানে ১৯৯টি দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এরই মধ্যে বিশ্বের প্রায় সোয়া ছয় লাখ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতালিতে এ পর্যন্ত ৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে, যা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দেশটিতে প্রতিদিনই মৃত্যুর হার বেড়েই চলছে। এরপর রয়েছে স্পেন। সেখানেও মৃত্যুর হার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি নিউইয়র্কের মেয়র ব্লাজিও তার নগর বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, এপ্রিল ও মে মাসে করোনা পিক আক্রমণে পৌঁছাবে। এই দেশগুলো বলছে, তারা সময় মতো লকডাউন করেনি বলেই চরম মাত্রায় করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে। উন্নত বিশ্বও আজ একই কথা বলছে। সুতরাং এই আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় লকডাউনের কোনো বিকল্প নাই। কেবলমাত্র লকডাউনই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে এবং করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করা যেতে পারে। নইলে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইটা সম্ভব হবে না।

বিজ্ঞাপন

এবার আসা যাক যে দেশটি থেকে করোনার উৎপত্তি সেই চীন নিয়ে। চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চীন ওই এলাকাটিকে পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অর্থাৎ কয়েকদিন আগ পর্যন্ত উহান ছিল লকডাউন। আর এ কারণেই প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে এ পর্যন্ত মাত্র ৮১ হাজার নাগরিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। আর মারা গেছে ৩ হাজার তিনশ’র মতো মানুষ। এছাড়া চীনে এখন আক্রান্তের হার প্রায় শূন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে। এখন চীনে যারা আক্রান্ত হচ্ছে তারা দেশের বাইরে থেকেই এই ভাইরাসটি নিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

চীনের উহান এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশের ৬৪ জেলাকে লকডাউনের আওতায় আনতে হবে। যদিও সরকার প্রায় দশদিনের জন্য সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই ছুটিতেও বাঙালির মনে লেগেছিল উৎসবের আমেজ। সরকার ছুটি দিয়েছে ঘরে থাকার জন্য। অথচ মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটেছে গ্রামের বাড়ির দিকে। এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। তখন অনেককেই দেখা গেছে প্রমোদ ভ্রমণে বের হতে। কোনো কিছুতেই যখন মানুষকে সচেতন করা যাচ্ছে না তখন সরকার মাঠে প্রশাসনের পাশাপাশি সশস্ত্রবাহিনীকেও নামিয়েছে।

যদি সরকার বর্তমান অবস্থাকে সামাল দিতে না পারে তবে সামনে আমাদের জন্য ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে যদি ৩ শতাংশ মানুষও করোনায় আক্রান্ত হয় তবে সেই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। আর হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ডায়াবেটিকস, ক্যান্সার রোগীসহ বয়স্কদের মৃত্যুহার বিবেচনা করলে গোটা দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে চলে যাবে। ঠিক যেমনটা হয়েছে ইতালিতে। ইতালির বারগামো শহরে আটলান্টা নামে ফুটবল দল আছে। এই আটলান্টার সঙ্গে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া ফুটবল দলের সিরা’আ লিগের ফুটবল ম্যাচ হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন সেখানে ৪০ হাজার দর্শকের সমাগম হয়েছিল। দর্শকদের মধ্যে ছিল করোনা আক্রান্ত রোগীও। কিন্তু তখন কেউ বিষয়টা টের পায়নি। খেলা শেষে সবাই ফিরে যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ করছে, ওই খেলার মাঠ থেকেই করোনাভাইরাস পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং যা ১ মার্চ ইতালিতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। এখনতো ইতালি মৃত্যুপুরী। উন্নত বিশ্বের সাজানো-গোছানো শহরের মানুষ্য সভ্যতা বলতে গেলে ধ্বংসের মুখে।

করোনা মোকাবিলায় উন্নত বিশ্ব যেখানে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে এই ভাইরাসটি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়লে এই দরিদ্র দেশের পক্ষে তা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৮ জন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন। এই হার আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। তাই সরকারের উচিত দেশের সবগুলো জেলাকে লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসা। তা না হলে দাবানলে যেমন বনের পর বন উজাড় হয়, তেমনি এই ভাইরাসে মানুষ মরে শহরের পর শহর উজার হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে নানা রকম অক্ষমতা রয়েছে। আর নতুন ধরনের এই সমস্যা মোকাবিলা করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাও আমাদের নেই। তাই উন্নত বিশ্ব এই সমস্যার সমাধান যেভাবে করছে আমাদেরও সে পথে এগোতে হবে। আমেরিকা কানাডাসহ ইউরোপের সব দেশ লকডাউন করেছে। পাশের ছোট দেশ নেপাল মাত্র দুজন করোনা রোগী পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লকডাউন করে দিয়েছে। পাশের দেশ ভারতও লকডাউন করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘জনতা কারফিউ’ দিয়ে মানুষের অংশগ্রহণ দেখে সারাদেশে লকডাউন করে দেয়। আমাদেরও ভারতের মতো পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত।

বাংলাদেশের সরকার ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি অফিস বন্ধ ঘোষণা করেছে। অবশ্যই এটা ভালো উদ্যোগ। তবে আগামী ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি কোয়ারেনটাইন বা সামাজিক দূরত্ব বা সঙ্গ নিরোধ না মানি তাহলে করোনা ভয়াবহতা ডেকে আনতে পারে। কারণ বিদেশ থেকে যারা দেশে ফিরেছে প্রথম দিকে তাদের কোয়ারেনটাইনে থাকার কথা বলা হলেও তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় বিদেশ থেকে যাত্রী আর আসছে না। কিন্তু যারা এসেছে তারা হোম কোয়ারেনটাইন না মেনে দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই বিপদ আমরা এখন হয়তো আঁচ করতে পারছি না। কিন্তু মানুষ যদি এখনও বাড়ির বাইরে বের হয়, ঘোরাফেরা করে, বাজারে যায় তবে করোনার ভয়াবহতা টের পেতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।

এদিকে সরকার জানিয়েছে বন্ধের সময় ব্যাংকগুলো আধাবেলা খোলা থাকবে। খোলা থাকবে হাসপাতাল, ওষুধের দোকান ও কাঁচাবাজার। এর পাশাপাশি জরুরি পরিষেবা বিদ্যুৎ, পানি এবং ব্যাংকের এটিএম বুথও খোলা রাখা হবে। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, আমরা অনেক সময় বিভিন্ন অজুহাতে তেমন প্রয়োজন না থাকলেও প্রায় মিছিলের মতো করেই রাস্তায় নামি। আমাদের অজুহাত থাকে টাকা তোলার, ওষুধের দোকানে যাওয়ার ও বাজার করার। আমাদের সকলকেই সচেতন হতে হবে জরুরি প্রয়োজনে যেন খুব কম সময়ের জন্য বাইরে থাকি। যদিও প্রশাসন এবং সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা মানুষের হোম কোয়ারেনটাইন নিশ্চিত করতে রাস্তায় নেমেছে। যারা রাস্তায় বের হচ্ছে তাদের সঠিক কারণ দর্শাতে বলা হচ্ছে। এভাবেই আমাদের চলতে হবে। তবে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হবে পুরো দেশে লকডাউন ঘোষণা করা।

এখন আসি একটু অন্য প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলতে হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) কার্যক্রম নিয়ে। মানুষের অভিযোগ, আইইডিসিআর যেসব হটলাইন দিয়েছে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। আর শত চেষ্টার পর যোগাযোগ করা গেলেও বিদেশ ফেরত বা তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে অথবা সাসপেকটেড রোগী ছাড়া কারও নমুনা পরীক্ষা করছে না প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমদিকে নমুনা পরীক্ষার কিট সংকটের কথা বলা হলেও এখন চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে কিট আসছে। তাই প্রতিষ্ঠানটির উচিত এই কিট সারাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে দিয়ে করোনা শনাক্তের কাজ ত্বরান্তিত করা।

এদিকে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো হাঁচি, কাশি বা সর্দি-জ্বর অথবা অ্যাজমা আছে এমন রোগীদের ভর্তি নিচ্ছে না। তারা সবাইকে করোনা আক্রান্ত রোগী বলে সন্দেহ করছে। আবার চিকিৎসক বা নার্স যারা আছেন তারা যে করোনা আক্রান্ত রোগীকে যে সেবা দিবে সেজন্য তাদের অতি প্রয়োজনীয় পিপিই (personal protective equipment) নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে চিকিৎসকরা রেইনকোট পড়ে অথবা মাথায় পলিথিন বেঁধে মাস্ক পরে চিকিৎসা দিচ্ছেন। ছবিগুলো সারাক্ষণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে; যা দেশের জনগণের কাছে এবং বিদেশে সরকার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও ইমেজ সংকট তৈরি করছে।

যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই পৌঁছে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, এই মুহূর্তে যারা চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত, তাদের পরিবারের দিকেও সরকারের খেয়াল রাখতে হবে। খবু বেশি সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স যদি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তাহলে তারা চিকিৎসা সেবা দিতে পারবেন না। করোনা প্রতিহত করতে চিকিৎসক-নার্সরা একেকজন সৈনিক। তাদের পাশে আমাদের দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক: গবেষক

করোনাভাইরাস বাংলাদেশ বিশ্ব পরিস্থিতি লকডাউন

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর