ওয়ার্ক ফ্রম হোম: ভবিষ্যতের অফিস ব্যবস্থা, বাড়াবে কর্মক্ষমতা
২৯ মার্চ ২০২০ ১৫:১৩
ঢাকা: বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যামাজন, টুইটার, শেভরন, হিটাচির মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের বাড়িতে থাকতে বলছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মীরা তাদের বাড়িতে বসেই কাজ করছেন।
বেশ কিছু বছর ধরে বিশ্বব্যাপী এই রিমোর্ট ওয়ার্কিং বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এটা শুরু করলেও বেশিরভাগই নতুন করে এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহস পায়নি। তবে করোনাভাইরাসের কারণে তারাও শেষ পর্যন্ত বাধ্য হচ্ছে। তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ঠিক এই মুহূর্তে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো, তাদের কর্মচারীরা কতটুকু প্রস্তুত এই ব্যবস্থার জন্য?
ওয়ার্ক ফ্রম হোম এখন শুধু আর কাস্টমার কেয়ার টাইপের চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কম্পিউটার, আইটি, হেলথ, সেলস, কপিরাইটার, ট্রান্সলেশন, টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও এডুকেশন সেক্টরে ব্যাপকভাবে চালু হচ্ছে রিমোট ওয়ার্কিং। পরিবর্তনের এই যুগে ওয়ার্কিং ফ্রম হোমের মাধ্যমে জীবন ও কাজের মধ্যে চূড়ান্ত রকমের ভারসাম্য আসতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।
আমেরিকান সাইকোলোজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, রিমোট ওয়ার্কিং বা ওয়ার্কিং ফ্রম হোমের মাধ্যমে কর্মীদের জব স্যাটিসফেকশন বাড়ছে, বাড়ছে কর্মক্ষমতা। এই পরিস্থিতিতে কী করে আরও বেশি রিমোর্ট ওয়ার্কিং বাড়ানো যায়, সেটা নিয়েও চলছে বিস্তর চিন্তা-ভাবনা।
যুক্তরাষ্ট্রের চাকরিজীবীদের সারাক্ষণ অফিসে থাকার বদলে বাড়িতে অথবা পছন্দ মতো স্থানে বসে প্রয়োজনীয় কাজটুকু করে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইস ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাড়ি থেকে অফিসের কাজ করার প্রবণতা সেখানে দিন দিন বেড়েই চলেছে। ১৯৮০ সালে যেখানে প্রায় ৫ লাখ বা মোট চাকরিজীবীদের ০.৭ শতাংশ মানুষ বাড়ি থেকে অফিসের কাজ করতো। ২০১৭ সালে এসে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৩৪ লাখে বা মোট চাকরিজীবীদের ৩ শতাংশে, যারা অফিসের কাজ বাসায় বসে করে থাকে।
তবে সেলস ও ফাইনান্স বিভাগের চাকরিতে এই সংখ্যাটা আরও বেশি। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদেরও বাড়ি থেকে কাজ করার সুযোগ বাড়াচ্ছে।
টেলিকমিউনিকেশনস ব্যবস্থার উন্নয়ন সুস্পষ্টভাবেই এই কৃতিত্বের দাবিদার। ওয়ার্কিং ফ্রম হোম ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে চালু হলে অর্থনীতিতেও বেশ একটা প্রভাব রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন, যানবাহনের ব্যবহার কমবে এবং গৃহস্থালির কাজের পরিমাণ বাড়বে। তবে এই প্রভাব, এক শহর থেকে অন্য শহরে কিংবা বয়সভেদে ভিন্ন হতে পারে।
২০১৯ সালের শেষের দিকে Zapier.com একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে দেখা যায়, ৭৪ শতাংশ মানুষ ওয়ার্কিং ফ্রম হোম সুবিধা পেলে তাদের বর্তমান চাকরি ছেড়ে দিতে চাই।
অফিসের তুলনায় বাড়িতে বসে কাজ করলে একজন কর্মী বেশি কাজ করতে পারেন। স্ট্যানফোর্ড গ্রাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথাগত অফিস ওয়ার্কের তুলনায় ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মাধ্যমে ১৩ শতাংশ বেশি কাজ হয়। পাশাপাশি যারা রিমোর্ট ওয়ার্কিং করেন তারা তুলনামূলক কম অসুস্থতাজনিত ছুটি নেন। এছাড়া কর্মীরা তাদের কাজের জন্য পছন্দমতো সময় বেঁছে নিতে পারায় অল্প সময়ে বেশি কাজ করতে পারেন।
মোটা দাগে বেশকিছু কারণে ওয়ার্কিং ফ্রম হোম বা রিমোট ওয়ার্কিং ব্যাপকভাবে বাস্তবায়নের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে আছে-
বাড়ি বসে অফিস করলে একদিকে যেমন যাতায়াতের সময়টুকু বাঁচবে, অন্যদিকে খরচটাও হবে না। পাশাপাশি পোশাক-আশাক ও আনুষঙ্গিক খরচও কমে আসবে। অন্যদিকে কর্মীরা বাসায় বসে কাজ করলে কমবে অফিস পরিচালনা খরচ।
ইউএস ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালের তুলনায় বর্তমান সময়ে এসে জ্বালানী তেলের ম্যূল্য প্রায় ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকায় ৮০ ভাগ মানুষ নিজের গাড়িতে অফিসে যাতায়াত করেন এবং তাদের মধ্যে ৭৫ ভাগ মানুষই একা গাড়ি ব্যবহার করেন। ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে এবং বিভিন্ন টার্ন নিতে গিয়ে প্রত্যেকে বছরে অতিরিক্ত ১৯ গ্যালন করে পেট্রোল পোড়ান। এছাড়া দীর্ঘ ভ্রমণ করে অফিসে যাওয়ার ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্লান্তি তৈরি হয়, যা কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
কানাডা লাইফের ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি অফিসের তিনজন কর্মীকে অফিসে ও তিন জন কর্মীকে বাসায় বসে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে যারা অফিসে বসে কাজ করে, তারা দশের মধ্যে পায় ৬.৫ এবং যারা রিমোর্ট ওয়ার্কিং করে তারা ৭.৭ পয়েন্ট করে পায় প্রোডাক্টিভিটি ইনডেক্সে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে ৫ কিলোমিটার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে অফিসগামী যাত্রীদের মানসিক চাপ তৈরি হয়। এই চাপ আবার কাজ করছে অন্যান্য রোগের উৎস হিসেবে, তার প্রভাব পড়ছে কর্মক্ষেত্রেও। পাশাপাশি যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
পাশাপাশি ওয়ার্কিং ফ্রম হোম থেকে আরও যে সুবিধাগুলো পাওয়া সম্ভব তা হলো, পছন্দ মতো যেকোনো স্থানে বসে অফিস করা যায়; অফিস হবে নিজের পছন্দমতো; কাজের জন্য বেছে নেওয়া যায় নিজের পছন্দমতো সময়; মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। সবশেষে কমে যায় অফিস পলিটিক্স।
সারাবাংলা/এমআই