Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ওসির রুমে ঝুলন্ত লাশ: নির্যাতনের চিহ্ন শরীরজুড়ে


৩১ মার্চ ২০২০ ০৯:৫৬

ঢাকা: গত বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) বরগুনার আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) রুম থেকে হেফাজতে থাকা সন্দেহভাজন আসামি শানু হাওলাদারের (৫২) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে ওই থানারই পুলিশ। উদ্ধার হওয়া ওই ব্যক্তির শরীরে নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন থাকলেও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল বাসারের (ওসি) দাবি, ‘কোনো নির্যাতন করা হয়নি। সে আত্মহত্যা করেছে।’ তবে ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি, এটি আত্মহত্যা নয় বরং ওসির দাবি করা তিন লাখ টাকা দিতে না পারায় নির্যাতন করে তাকে মেরে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, গত সোমবার (২৩ মার্চ) শানু হাওলাদার (৫২) নামের ওই ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে রাত ১১টার দিকে বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালীর নিজ বাড়ি থেকে ধরে আনে আমতলী থানার তদন্ত ইন্সপেক্টর (ওসি) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির নেতৃত্বে থাকা একদল পুলিশ। এরপর টানা তিন দিন পুলিশ হেফাজতে রাখলেও শানু হাওলাদারকে আদালতে সোপর্দ করেননি ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন। এমনকি থানায় নিয়ে আসার পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে দেয়নি।

বিজ্ঞাপন

শুধু তাই নয়, শানু হাওলাদারের অপরাধ কি সেটি জানতে স্থানীয় নির্বাচিত ইউনিয়ন চেয়ারম্যান থানায় গেলেও তাকেও শানুর সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি পুলিশ। এমনকি তার বিরুদ্ধে কি অপরাধ রয়েছে সে বিষয়টিও ‘জানা নেই’ পুলিশের। শানুর সঙ্গে দেখা না করে রাতে বাড়ি ফেরার পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই চেয়ারম্যান শুনতে পান শানু আত্মহত্যা করেছে। চেয়ারম্যানের দাবি, ‘এটি কোনভাবেই আত্মহত্যা নয় বরং হত্যা।’

গুলিশাখালীর দুইবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. নুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, “শানুকে যে সময়ে থানায় ধরে নেওয়া হয়েছে সে সময় আমি ছিলাম ঢাকাতে। এরপর মঙ্গলবার বিকেলে আমি এলাকায় গেলে শানুর ছেলে কান্নাকাটি করে বলল, ‘তার বাবাকে বিনা অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।’ এটা শুনে আমি রাতেই থানায় যায়। কিন্তু ওসি কোনভাবেই আমাকে শানুর সঙ্গে দেখা করতে দিলো না। আবার তার অপরাধ কি সে বিষয়েও কোনো কিছু জানাতে পারল না। আমি ওসি কে বলেছিলাম তার বিরুদ্ধে তো কোন অপরাধ নেই, কোন মামলাও নেই। তাহলে তাকে ধরে আনা হয়েছে কেন। জবাবে ওসি বলল, ‘তার থেকে কিছু তথ্য নেওয়ার জন্য আনা হয়েছে। কালকেই ছেড়ে দেওয়া হবে।’ এসব শুনে আমি বাসায় চলে আসি। কিন্তু দুর্ভাগ্য সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনি শানু নাকি আত্মহত্যা করেছে।”

তিনি আরও বলেন, ‘পরে থানায় ছুটে যাই দ্রুত। গিয়ে দেখি ওসির রুমে সে ফ্যানের সঙ্গে রশি গলায় দিয়ে ঝুলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো পুলিশ হেফাজতে থাকা শানু কিভাবে রশি পেল আর কিভাবে ওসির রুমে গিয়েই বা কিভাবে গলায় দড়ি দিলো?’

কিন্তু পুরো ঘটনা নিয়ে এখন নিশ্চুপ পুলিশ। কেন শানুকে থানায় নেওয়া হলো, কিভাবে তার শরীরে নির্যাতনের চিহ্ণ এলো, সন্দেহভাজন আসামি কি করে ওসির রুমে গেলেন- এসবের কোনো উত্তরই নেই থানা পুলিশের কাছে। ঘটনায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ‘তদন্তের স্বার্থে’ এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।

জানা গেছে, ঘটনাটি হত্যা না আত্মহত্যা তার কারণ খুঁজতে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. তোফায়েল আহম্মেদকে প্রধান করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বরগুনা সদর) মো. মহব্বত আলী ও সহকারী পুলিশ সুপার (আমতলী-তালতলী সার্কেল) সৈয়দ রবিউল ইসলামকে নিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে সুনির্দিষ্ট কোন সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে না বলা হলেও জরুরি ভিত্তিতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন।

এসপি মারুফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘থানায় লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের জরুরি ভিত্তিতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) আবুল বাসার, তদন্ত ওসি মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও সে সময়ের ডিউটি অফিসার এএসআই আরিফুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।’ তারা দোষী প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

থানার ভেতরে নিরাপরাধ ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তিনদিন আটকে রাখা এবং স্বজনদের সঙ্গে কোনো রকমের যোগাযোগ করতে না দেওয়া কি দোষের নয় এমন প্রশ্নে এসপি মারুফ বলেন, ‘যেহেতু বিষয়টি তদন্ত চলছে, তাই এ মুহূর্তে এ বিষয়ে আর কিছু বলা সম্ভব নয়।’

চার দিন পার হয়ে গেল, তদন্ত শেষ হবে কবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জরুরি ভিত্তিতে দিতে বলেছি।’

তবে অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত কমিটিও আত্মহত্যার পক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করার চেষ্টা করছেন। এজন্য ভুক্তভোগীদের নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পরিবারটির।

নিহত শানু হাওলাদারের কিছু স্থিরচিত্রও এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে। সেই সব ছবিতে দেখা যায়, নিহত শানুর শরীরের একাধিক স্থানে আঘাতের পর কালো দাগ ও ফোলা জখম হয়ে আছে। নিহত শানুর ছেলে সাকিব হাওলাদার অভিযোগ করেছেন, এমন দৃশ্য খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যাওয়ার পরও ময়নাতদন্তে ‘পুলিশের কথা মতো’ আত্মহত্যা লেখা হয়েছে।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাবার শরীরে যে পরিমান আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে তাতে ময়নাতদন্ত ছাড়াও বলা যায় এটা নির্যাতন। কিন্তু তারপরও ময়নাতদন্তে নাকি আত্মহত্যা লিখেছে। যদিও হাসপাতাল থেকে আমাদের এ বিষয়ে কেউ কোন তথ্য দিচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলে বলে মামলা হলে আদালতে জমা দেবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে থানার একটি সোর্সের মাধ্যমে জানতে পেরেছি ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে আত্মহত্যা উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের সঙ্গে কি হচ্ছে! একদিকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বলছে, অন্যদিকে উপর থেকে চাপ দিচ্ছে এ বিষয়ে চুপচাপ থাকতে। আবার তদন্তও করছে পুলিশ। পুলিশ কি পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেবে?’

ঘটনার তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. তোফায়েল আহম্মেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি এখন তদন্তাধীন। তাই এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’

তদন্তে নির্যাতনের কোনো প্রমাণ পেয়েছেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা তো মেডিকেল রিপোর্টই বলবে আমরা এখনও সেটি পাইনি। তবে যাদের বিরুদ্ধে গাফলতি পাওয়া গেছে তাদের তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে যদি আরও দোষ পাওয়া যায় তাহলে আরও শাস্তি হবে।’

তবে তদন্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে স্বজনদের শঙ্কার বিষয়টি তিনি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত তো পুলিশই করবে। অন্য কেউ করলে করুক, আমরা আমাদেরটা করছি।’

ময়নাতদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনা জেলা সিভিল সার্জন হুমায়ুন শাহিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ময়নাতদন্তেরর প্রতিবেদন থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

নির্যাতনের কোন আলামত পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কথা বলব না কারও সঙ্গে। যা যা পেয়েছি তা লিখে দিয়েছি। দরকার হলে থানা থেকে জেনে নেন।’ এমনিতে করোনা নিয়ে ঝামেলায় আছি বলেই তিনি ফোন কেটে দেন। তবে তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এখনও মেডিকেল রিপোর্ট পাননি।

কি ঘটেছিল সেদিন রাতে?
নিহত শানু হাওলাদারের ছেলে সাকিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেদিন (২৩ মার্চ) রাত ১১টায় ওসি মনোরঞ্জনসহ কয়েকজন পুলিশ গিয়ে আমাদের ঘরের দরজা নক করে বলে আমরা প্রশাসনের লোক, পুলিশ। দরজা খোলেন। এরপর আমার মা দরজা খুলে দিলে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবার খোঁজ করে। পরে বাবা রুম থেকে বের হয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালে তারা বলে, ‘আপনি শানু হাওলাদার?’ বাবা ‘হ্যাঁ’ বললে তারা আবারও বলে ‘আপনি আইন মানেন তো?’ বাবা হ্যাঁ বললে তারা বলে ‘তাহলে আপনাকে একটু থানায় যেতে হবে। ওসি স্যার যেতে বলেছেন।’

‘তখন আমার বাবা বলে আমি তো জানা মতে কোনো অপরাধ করিনি। কিসের জন্য থানায় যেতে হবে এতো রাতে? তখন মনোরঞ্জন বলেন, ‘আপনি মিজানুর রহমান হাওলাদারকে ছিনেন। মার্ডার মামলার আসামি সে। তার বিষয়ে কিছু তথ্য দিতে হবে থানায়। মিজান আমার বাবার সৎ ভাই। গত বছরের ৩ নভেম্বর এলাকায় একটা হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই মামলায় মিজান আসামি। যদিও আমার বাবা এসবের বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাই বাবা তাদের জানান, আমি তাদের বিষয়ে কিছুই জানি না। বিশ্বাস করেন। মনোরঞ্জন তবু টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এসময় আমাদের ঘরে থাকা একমাত্র ফোনটাও মায়ের কাছ থেকে নিয়ে নেয় তারা।’

সাকিব আরও বলেন, “আমি বরগুনা পলিটেকনিক্যালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ৪র্থ সেমিস্টারের পড়ি। এজন্য বরগুনা সদরে থাকি। তাই ওইদিন আমি বাসায় ছিলাম না। অনেক রাতে মা পাশের বাড়ি থেকে আমাকে কল দিয়ে বিষয়টি জানায়। পরে সকাল সকাল আমি থানায় যায়। কিন্তু আমাকে থানায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমি দুপুরে ওসি আসার পর থানায় ঢুকে বাবাকে দূর থেকে একটু দেখলাম। বাবা দূর থেকে বললেন তাকে বের করতে ‘কিছু একটা’ করার জন্য। তখন আমি ওসির কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ওসি মনোরঞ্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। তখন সে থানায় ছিল না। তাই আমি তাকে কল দিয়ে দেখা করার কথা বলে সে জানায় থানার গেটে আসার জন্য।”

গেইটে গিয়ে মনোরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন, ‘বাবাকে বের করতে হলে ৩ লাখ টাকা দিতে হবে। দ্রুত ছুটে গেলাম ওসির কাছে। কিন্তু ওসি বললেন, মনোরঞ্জন যা বলে তা শোনার জন্য। নিরুপায় হয়ে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে ১০ হাজার টাকা ওসিকে দিলাম। তিনি এ টাকা নিয়ে বললেন, ‘বাকি টাকা আনলে বাবাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। পরে আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে গেলাম। তিনিও থানায় গিয়ে কিছু করতে পারলেন না।’

পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে এখন পর্যন্ত যতগুলো ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সবগুলো ঘটনাই বাংলাদেশ পুলিশের কোনো না কোনো ইউনিট তদন্ত করেছে। তাই পুলিশ তদন্ত করলে সেটি নিরপেক্ষ হবে না- এমন ধারণা মোটেও ঠিক না। এ ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়া অনুসারে প্রাথমিকভাবে যা যা করা দরকার, তা করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিটি প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ বাংলাদেশ পুলিশের যেকোনো সদস্যের সামান্যতম বিচ্যুতি হলেও অতীতের মতো তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

আমতলী থানা ওসির রুমে ঝুলন্ত লাশ নির্যাতন শানু হত্যা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর