Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আশা তার একমাত্র ভেলা


১ এপ্রিল ২০২০ ২৩:২৯

কী করলে কী হতো, কী করা উচিত ছিল— সে সময়টা খুব সম্ভবত আমরা পার করে চলে এসেছি। ডেঙ্গু নিয়ে আমি যতটা উচ্চকিত ছিলাম— লেখালেখি, লাইভে আসা— করোনা নিয়ে ততটাই নিশ্চুপ। এর একটাই কারণ, আমি এই ব্যাপারটা সম্পর্কে কম জানি। কোনো কিছু সম্পর্কে না জেনে বিস্তর বলতে বা লিখতে গেলে ভুল হয়। সে ভুলের মাশুল দিতে হতে পারে আমার কিংবা অন্য অনেক মানুষের। এ কারণে এসব ব্যাপারে রিস্ক নেওয়া যাবে না, রিস্ক নেওয়া উচিত হবে না।

আমি আসলে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম আপনাদের সঙ্গে। আলোচনা ধরনের। ধরে নিতে পারেন, আমরা সবাই তিন ফুট ব্যাসার্ধের একটি বৃত্তে তিন ফুট দূরে দূরে বসে আছি, আর কেন্দ্রে একটা টংয়ের দোকান, আমাদের হাতে চা, দুষ্ট লোকেদের হাতে চায়ের সঙ্গে টা। এতে গল্পটা জমে ভালো। আমরা যদি একটু খেয়াল করি (গ্রাফ-১), দুঃখজনক দেশ ইতালি, আমেরিকা, স্পেন, জার্মানির মতো প্রথম বিশ্বের দেশগুলো প্রথম কেস আইডেন্টিফাই করবার পরে লকডাউন করতে সময় নিয়েছে যথাক্রমে ৩৩ দিন, ৬৫ দিন, ৫২ দিন ও ৪৯ দিন। অর্থাৎ, এক থেকে দুই মাস পরে। এর ফল হাতেনাতে টের পেয়েছে তারা।

এখন আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশ, আমাদের পিপিই নেই, আমরা ইতালি থেকে লোক আসতে দিয়েছি, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনে রাখতে পারিনি— অনেক অনেক অসামঞ্জস্য আমাদের কাজে। একটু পজিটিভ কিছু যদি খুঁজতে যাই, আমাদের প্রথম কেস আইডেন্টিফাইড হয়েছিল ৮ মার্চে এবং আমরা ‘কার্যত’ লকডাউনে গিয়েছি ঠিক তার ১৬ দিন পরে। আমরা জানি, এর মধ্যে ফেরিতে, বাসে, ট্রেনে করে হাজার হাজার, লাখ খানেক মানুষ বাড়ি ফিরেছি, মসজিদে গিয়েছি, ওয়াজে গিয়েছি, পূন্য স্নানে গিয়েছি। এদের ইতর শ্রেণি বলে আমরা প্রচুর গালমন্দও করেছি। কিন্তু শুধু আমরাই কি এমন?

ইতালিতে প্রথম কেস আইডেন্টিফাই হয় ৬ ফেব্রুয়ারি। লকডাউন হয় ৩৩ দিন পরে ৯ মার্চ। আর ১৮ মার্চ, মানে ৯ দিন লকডাউনের মধ্যে ৪০ হাজার লোককে লকডাউন না মানার জন্য জরিমানা করা হয়েছে। তার মানে, আমরা একাই এমন না।  সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যে অসামঞ্জস্য আমরা লক্ষ্য করেছি এবং এর ফলে যে কার্টুন দৌড় আমরা দেখেছি, এর মধ্যেও অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা খুব দ্রুত লকডাউনে যেতে পেরেছি। এ ক্ষেত্রে আমরা একটু আশাবাদী হতে পারি যে লকডাউন প্রোপারলি মেইনটেইন করতে পারলে ইতালি, স্পেনে যে ম্যাসাকার চলছে, আমরা সেটা হয়তো একটু হলেও কমের মধ্যে রাখতে পারব।

এখন আরেকটা ব্যাপারে আসি। এতদিনে আমরা জেনে গেছি, সংক্রমণের পরে উপসর্গ আসতে ১৪ দিন লাগে। তবে সবকিছু অঙ্ক মেনে হয় না। প্রতি ১০০ জনে একজনের ক্ষেত্রে উপসর্গ প্রকাশ পেতে ১৯ থেকে ২০ দিনও সময় লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই ১ শতাংশ যারা, তারা রাস্তাঘাটে বের হয়ে একদম সেই বিখ্যাত ‘পেশেন্ট ৩১’ হতে পারেন, হাজার হাজার মানুষকে সংক্রমিত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সেফ হিসেবে ইনকিউবেশন পিরিয়ড ধরা যেতে পারে ২১ দিন। উপসর্গ প্রকাশ থেকে রোগী ভালোর দিকে যাচ্ছে নাকি মৃত্যুর দিকে, সেটির জন্য সময় লাগে আরও প্রায় ১৯.৯ বা ২০ দিন।  অর্থাৎ, এই ১৯+২১ = ৪০ দিন যদি লকডাউন করে রাখা যায় (গ্রাফ-২), তবে সেটি খুবই কাজে আসবে ধারণা করা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতির কী অবস্থা দাঁড়াবে, এখানে সেটি চিন্তার বাইরে রাখা হচ্ছে।

এক্ষেত্রে সবার মনে আশঙ্কা দেখা দিতে পারে, তবে কি কোনো আশার বাণীই নেই? এ ক্ষেত্রে আশার বাণী বলতে সংখ্যা দিয়ে আশা দেওয়া যায়, মুখে সামান্য হাসি ফোটানো যায়, তবে প্রতিটি সংখ্যার পেছনে আসলে আমাদের কারও না কারও প্রিয় মুখ লুকিয়ে আছে। ইতালির দিকে যদি আমরা আবার তাকাই, ২০১৮ সালে দেশটির ২২ দশমিক ৬ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মানুষের বয়স ছিল ৬৫ বছর বা তার বেশি। অন্যদিকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী মানুষের হার কেবল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগ। এটা একটা আশার বাণী হতে পারে।

যুক্তরাজ্য যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত করে, তখন তারা দিনে কয়টি করে পরীক্ষা করত জানেন? ওই দিন পরীক্ষা হয়েছিল ৩১টি, পরদিন ৫২টি, তারপরে ৭৩টি, এরপর থেকে কিছুদিন ১৫০ করে। আজ দুই মাস পরে এসে তারা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিট সংকট নিয়ে আইইডিসিআরকে গালমন্দ করা যায়, আমি নিজেও করি। কারণ ১৪ মার্চ আমি গ্লাভস পরে ডিউটি করেছিলাম, ছবি দিয়েছিলাম ফেসবুকে। বুধবার থেকে আমার তুমুল কাশি শুরু হলে আমি প্রচণ্ড ভয় পাই। হটলাইনে যোগাযোগ করে আইইডিসিআরে গেলেও আমার পরীক্ষা করা হয়নি। আমি ধৈর্য ধরেছি, ওষুধ খেয়েছি, এখন ভালো আছি। কাশির ধরন বুঝে আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নই। তবু আমি নিজ বাসায় একদম সত্যিকারের কোয়ারেনটাইনে থেকেছি। আলাদা খেয়েছি, আম্মা-আব্বার কাছেও যাইনি। এখন আরও ল্যাব করা হয়েছে (আটটি), কিছুদিনের মধ্যেই বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। আমরা প্রথম দিকে লেজেগোবরে করে ফেলেছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু এরপর যে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, উন্নত বিশ্বের প্রথম দেশগুলোর সঙ্গে তুলনায় গেলে আপনিও বলতে পারবেন, আমরা খুব খারাপ অবস্থানে নেই।

এখন প্রথম দিকের লেজে-গোবরে অবস্থার জন্য আমাদের কতটুকু মাশুল দিতে হবে, সেটিই বড় কথা। সব দেশই শুরুতে সেই লেজে-গোবরে করেছে, তার জন্য মাশুলও তাদের দিতে হয়েছে। আর এর কারণ এই ভাইরাস পৃথিবীর কাছে নতুন। কেউই জানে না কী করতে হবে। সবাই ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মাধ্যমে এগোচ্ছে। যুক্তরাজ্য ‘হার্ড (HERD) ইমিউনিটি’র পথে এগিয়ে বুঝতে পেরেছে, তারা শুধু লেজে-গোবরেই না, লেজে-গোবরে-চোনায়-পায়খানায় সব এক করে ফেলেছে। সে ভুলের মাশুলও এখন তাদের দিতে হচ্ছে।

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বা তার শেষে হয়তো আমরা একটা সার্জ দেখতে পেতে পারি। হুট করে বেশ কয়েকজন মারা গেল, এরপরে কন্সট্যান্ট রেটে মারা যাচ্ছে। আবার এমন নাও হতে পারে। সেটা নির্ভর করবে কোয়ারেনটাইন আমরা কতটা ভালোভাবে মেনে চলতে পারব, তার ওপর। অনুরোধ থাকবে কয়েকটি— একদম জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে না থাকলে ঘর থেকে বের হবেন না। আর আচমকা যে ‍মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথা বললাম, সেটি ঘটলেও আতঙ্কিত হয়ে হয়ে ‘কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন পথে যাই’য়ের মতো ভুল করে বসবেন না। আপনাকে তখনো ধৈর্য ধরে ঘরেই থাকতে হবে।

এরকম ঘটনা কিন্তু ঘটেছিল অস্ট্রেলিয়ার। দেশটিতে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ২৫ জানুয়ারি। তারা লকডাউনে যায় ৫৪ দিন বা প্রায় দুই মাস পর। এর মধ্যে ১৮ মার্চ থেকে তাদের প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা দুই থেকে তিনশ’র ঘরে ওঠানামা করছিল। এরপর হঠাৎ করেই ২২ মার্চ সে সংখ্যা এক লাফে পৌঁছায় ছয়শ’র কাছাকাছিতে। পরে সে সংখ্যা নেমেও আসে।

তো এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? একজন সিভিলিয়ান হিসেবে করণী একটাই— বাড়িতে থাকুন। কারও বাড়িতে যাবেন না, নিজের বাড়িতেও কাউকে ঢুকতে দেবেন না। আমি জানি, মানসিকভাবে আমরা সবাই অনেক ভেঙে পড়ছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বেঁচে থাকলে আকাশ ভরা তারা, মাঠ ভরা ফুল, টংয়ের চায়ের ঘ্রাণে আমরা আবার সবুজ হয়ে উঠব, সতেজ হয়ে উঠব। কিন্তু তার জন্য আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

কিছুদিন আগেও পিপিই নিয়ে সরকারের বিভিন্ন অবস্থান নিয়ে আমি খুবই বিরক্ত ছিলাম। লেখালেখিতে উষ্মাও প্রকাশ করেছি। আমি এখনো সেই মানুষগুলোর প্রতি বিরক্ত এবং এই মহামারির দিনে যারা যারা মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য দিয়েছে, আমাদের চিকিৎসকদের জনগণের মুখোমুখি করে আমাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি করতে চেয়েছে, তাদের সবার কথা আমি মনে রাখব, যদিও তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। পিপিই সংকট আশা করি দ্রুত কেটে যাবে। এখন একটা কথা বলুন, ইতালিতে কি ডাক্তারেরা পিপিই না পরে কাজ করেছে? সেখানে ৬০ জনেরও বেশি ডাক্তার প্রাণ হারিয়েছেন, স্পেনের মোট রোগীর ১২ শতাংশই মেডিকেল স্টাফ। এর অর্থ, পিপিই একটি সাপোর্টিভ গিয়ার, কোনো রক্ষাকবচ না।

তবে কি আমরা একটু করে হলেও আশার আলো দেখি? ব্যক্তিজীবনে আমি অত্যন্ত যুক্তিবাদী একজন মানুষ। তবুও চার দিন আগে এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই কেনো যেন মনে হলো, এই যাত্রায়ও আমরা হয়তো বেঁচে যাব অল্পের ওপর দিয়ে। কেন এমন মনে হলো, জানি না। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যতটা ঋজু, অনুজ্জ্বল লেগেছিল, ৩১ মার্চ প্রতিটি জেলার প্রশাসনের সঙ্গে লাইভ ভিডিও আলোচনায়, দিক-নির্দেশনা দেওয়ার সময় তাকে ততটাই আত্মবিশ্বাসী ও সপ্রতিভ মনে হয়েছে। খুব নিজস্ব একটি সূত্র থেকে জানি, নিজেদের হর্তা-কর্তা ভাবা কিছু ব্যক্তিকে অগ্রাহ্য করে তিনি বিভিন্ন হাসপাতাল ও মাঠ পর্যায়ে লোক নিয়োগ দিয়েছেন সঠিন তথ্য জানার জন্য। তার সূত্র ধরে পহেলা বৈশাখ পালন থেকে বিরত থাকা কিংবা সাধারণ ছুটি (কার্যত লকডাউন) আরও দীর্ঘ করার (১১ এপ্রিল পর্যন্ত) মতো কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপেরও দেখা মিললো। এখন বাকিটা আমাদের হাতে। এই দুর্যোগের দিনে সবাইকে ভিন্নভাবে ‘ঐক্যবদ্ধ’ হতে হবে, সেটা আলাদা আলাদাভাবে, নিজ নিজ ঘরে।

বাঙালির জাতির পিতার অমোঘ এক বাণী দিয়েই তবে শেষ করি, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ তা পারলে প্রধানমন্ত্রীর মতো আশাবাদও রাখতে পারি— এ যুদ্ধেও জয় আমাদের হবেই।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: চিকিৎসক

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

১। যুক্ত গ্রাফের জন্য কৃতজ্ঞ মেডিকেল অ্যান্থ্রপলজিস্ট আতিক আহসানের প্রতি

২। https://www.banglatribune.com/columns/opinion/616375/

৩। https://www.dw.com/bn/a-52965049

৪। https://www.independent.co.uk/news/health/coronavirus-uk-cases-tests-how-many-people-have-died-today-latest-figures-a9401516.html

৫। https://www.theguardian.com/world/2020/mar/18/italy-charges-more-than-40000-people-violating-lockdown-coronavirus

৬। https://www.nbcnews.com/news/world/medical-workers-spain-italy-overloaded-more-them-catch-coronavirus-n1170721

করোনাভাইরাস করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ কোভিড-১৯ কোয়ারেনটাইন লকডাউন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

৩ বছরের কাজ শেষ হয়নি ৬ বছরেও
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৩১

ব্রাজিলকে হারিয়ে প্যারাগুয়ের চমক
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৩০

সম্পর্কিত খবর