এসএম মুন্না
ঢাকা: ভাঙল প্রাণের মেলা। আজ বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টায় নিভল মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা আলো। এবারে বইমেলায় বিক্রি গতবারের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর বিক্রি হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই। যা গতবারের চেয়ে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা বেশি। এ বছর মেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪ হাজার ৫৯১টি।
একাডেমির সাধারণ জরিপে জানা গেছে, নতুন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এ বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪ হাজার ৫৯১টি। বিক্রি হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই। গতবার মেলার মোট বিক্রি ছিল ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুধু বাংলা একাডেমিই ১ কোটি ৫১ লাখ ২৪ হাজার টাকার বই বিক্রি করেছে। ধারণা করা হচ্ছে মাসজুড়ে প্রাঙ্গণে এসেছিলেন প্রায় সোয়া কোটি মানুষ। ৮ দিন ছিল মেলার শিশুপ্রহর।
মেলা প্রকাশের দিক থেকে এবারও এগিয়ে ছিল কবিতা। প্রবীণ-নবীন কবি মিলিয়ে কবিতার বই এসেছে ১ হাজার ৩৩৫টি। দ্বিতীয় অবস্থানে ছোটগল্প, ৬১৫টি। তৃতীয় অবস্থানে উপন্যাস, ৫৮৭টি। চতুর্থ অবস্থানে প্রবন্ধ, ২২৩টি। পঞ্চম অবস্থানে শিশুতোষ, ১১৪টি। এবং ষষ্ঠ অবস্থানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই ৮২টি।
মানসম্মত বইয়ের জন্য এবার জমা পড়েছিল ৪ হাজার ১৩৪টি বই। এর মধ্যে মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা ২৩ শতাংশ অর্থাৎ ৪৮৮টি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বই মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে মোড়ক উন্মোচন হয় ৮৫০ নতুন বইয়ের। আর এসব বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন প্রায় দুই হাজার ৫৭৫ জন ব্যক্তিবর্গ।
শেষ দিনের মেলার চিত্র: তিনটা বেজে ওঠার আগেই মেলা প্রাঙ্গণের বাইরে মানুষের ঢল নামে। ঘঁড়ির কাঁটা তিনটা ছুঁতেই খুলে দেওয়া হয় মেলা গেট। মুর্হূতেই মেলা প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠে পাঠক-ক্রেতার পদচারণায়। স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম হয়েছে মেলার শেষ দিন বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি)।
বেলা তিনটাতেই তালিকা হাতে নিয়ে পছন্দের বইটির খোঁজে ব্যতিব্যস্ত হাজারো পাঠক-ক্রেতা। সন্ধ্যায় জনারণ্যে পরিণত হয় মেলা। মেলার শেষ দিনে এত লোক সমাগম হওয়ায় দীপ্ত টিভির রিপোর্টার ঝুমি রহমান এই প্রতিবেদকের কাছে অনেকটাই বিষ্ময় প্রকাশ করে বললেন ‘ভাই আজকের ভিড়ের কারণে ১০ বার ট্রাই করেও মেলার মাঠ থেকে পিটিসি দিতে পারলাম না।’
শেষ দিনেও প্যাভিলিয়ন ও স্টলে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। বিক্রয়কর্মীদের গলদঘর্ম পরিশ্রম করতে দেখা গেছে ক্রেতাদের চাহিদামাফিক বইয়ের যোগান দিতে গিয়ে। বাংলা একাডেমি, অন্যপ্রকাশ, পাঞ্জেরী, আগামী, ঐতিহ্য, অবসর, প্রথমা, ইউপিএল, ইত্যাদি, অনুপম, সাহিত্যপ্রকাশ, পাঠক সমাবেশ, কাকলী, অনন্যা, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, উৎস, অ্যাডর্ন, শ্রাবণসহ বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ও স্টলে ছিল ক্রেতায় ঠাসা।
মেলা নিয়ে বিশিষ্টজনের অভিমত: মেলা প্রসঙ্গে কথা হয় বিশিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে। স্বনামধন্য শিশুসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘বইমেলা তো শুধু আর বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রাণের টানেই সবাই আসে। পাঠকদের সন্তুষ্ট রাখা বেশ কষ্টকর। তারপরও চেষ্টা করে চলেছি পাঠকদের সন্তুষ্ট রাখতে।’
কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘সত্যিই মনটা খারাপ। আবার এমন একটি প্রাণোচ্ছ্বল মেলার জন্য সারাবছরই অপেক্ষায় থাকব।’
জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা সমিতির নির্বাহী পরিচালক ও পাঞ্জেরী প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী কামরুল হাসান শায়ক সারাবাংলাকে বলেন, ‘একুশে বইমেলা এ দেশের সাংস্কৃতিক জাগরণকে ক্রমাগত সংহত ও শাণিত করে তুলছে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে সৃজনশীল প্রকাশনা জগতে গড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি গড়ে উঠছে বিশাল পাঠক সমাজ। সাহিত্য ও সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার যারা নিরন্তর সাধক, তাদেরও সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে।’
একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেলার সাফল্য নিয়ে আমরা অভিভূত। সবার সহযোগিতায়ই এমন সফল সমাপ্তি ঘটেছে। বইমেলাকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য সব মহলের পরামর্শ গ্রহণ করা হবে।’
সমাপনী আয়োজন: একাডেমির মেলা মঞ্চে ছিল সমাপনী আয়োজন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব মোহাম্মদ ইব্রাহীম হোসেন খান। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। মেলা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন মেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। সভাপত্বি করেন একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস প্রফেসর আনিসুজ্জামান।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিল তা এবারের মেলাতেও প্রমাণিত হয়েছে। এ বছরেরর ভুল-ভ্রান্তিগুলো হয়তো আগামী মেলায় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।’
আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষাস্তরে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক কম প্রকাশিত হয়। এ ধরনের বই আরও প্রকাশিত হওয়া জরুরি। তিনি বলেন, এবারের গ্রন্থমেলায় শিশু ও অভিভাবকসহ প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়।’
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি পরিচালিত চারটি গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রথমা প্রকাশনকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০১৮, ২০১৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য অলকানন্দা প্যাটেল রচিত ‘পৃথিবীর পথে হেঁটে’ গ্রন্থের জন্য বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, সুফি মুস্তাফিজুর রহমান রচিত ‘বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার’ গ্রন্থের জন্য জার্নিম্যান বুকস, মঈন আহমেদ সম্পাদিত ‘মিনি বিশ্বকোষ পাখি’ গ্রন্থের জন্য সময় প্রকাশনকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৮, ২০১৭ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য চন্দ্রাবতী একাডেমিকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০১৮ এবং ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কথাপ্রকাশকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৮ প্রদান করা হয়।
পুরস্কারপ্রাপ্ত সকল প্রকাশককে ২৫ হাজার টাকার চেক, সনদ ও ক্রেস্ট তুলে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
উদ্বোধন ও অন্যান্য তথ্য: ১ ফেব্রুয়ারি মেলা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একাডেমির রবীন্দ্র চত্বরে মেলা মঞ্চে প্রতি সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় নানা বিষয়ের সংযোজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছিল শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সঙ্গীত প্রতিযোগিতা। বইমেলায় ৭১৯ ইউনিটে ৪৫৫টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্যাভিলিয়ন ছিল বাংলা একাডেমিসহ ২৪টি। লিটলম্যাগ চত্বরে ১৩৬টি প্রতিষ্ঠানকে তাদের প্রকাশনা প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ছোট ছোট প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব লেখক বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া হয় জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের স্টলে। মেলা প্রাঙ্গণকে বিশিষ্টজনদের নামে ১১টি চত্বরে বিভক্ত করা হয়। স্মরণ করার হয় বিশিষ্ট গুণীজনকে।
মেলার আলোচিত বই: প্রেম কাহিনী ও পতন-শওকত আলী (বিদ্যাপ্রকাশ), সেরা সাত মুক্তিযু্দ্ধ উপন্যাস-হুমায়ূন আহমেদ (অবসর), নদী কারো নয়-সৈয়দ শামসুল হক (অন্যপ্রকাশ), রাই কুঁড়িয়ে বেল-হাসান আজিজুল হক (ইত্যাদি), পা রাখি কোথায়-সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (অন্বেষা প্রকাশন), সংকট ও সুযোগ-আবুল মাল আবদুল মুহিত (সময় প্রকাশন), গল্পে গল্পে ব্যাকরণ-যতীন সরকার (আলোঘর), অবিস্মৃত স্মৃতি-শওকত আলী (ইত্যাদি), আমার ইলিয়াস-হাসান আজিজুল হক (ইত্যাদি), স্বদেশ সমাজ সংস্কৃতি-সন্জীদা খাতুন (নবযুগ), অভাজনের রবীন্দ্রনাথ-মফিদুল হক (বিদ্যাপ্রকাশ), আপন আলোয় দেখা-সেলিনা হোসেন (সময়), বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বহুমাত্রিক বিশ্নেষণ-শামসুজ্জামান খান (বাংলা একাডেমি), মুক্তবুদ্ধির চড়াই-উতরাই-যতীন সরকার (কথাপ্রকাশ), পৃথিবীর পথে হেঁটে-অলকানন্দ প্যাটেল (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স), বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার-সুফি মুস্তাফিজুর রহমান (জার্নিম্যান), মিনি বিশ্বকোষ পাখি-মঈন আহমেদ (সময়), অনন্তের বাঁশি-মহাদেব সাহা (অনন্যা), কবিতা বিষয়ে অধিবিদ্যা পাঠ-পাবলো শাহি (ছোট কবিতা), মৃত মনিয়ার মত-হেনরী স্বপন (শ্রাবণ প্রকাশনী), একা এবং এক সঙ্গে নির্বাচিত আশি ১৯৬০-২০১০-হাসনাত আবদুল হাই (পাঠক সমাবেশ), ভালো থাকার নির্দেশ আছে-নাসির আহমেদ (রয়েল পাবলিশার্স), আমার নাম মুজিব ইরম আমি একটি কবিতা বলব-মুজিব ইরম (চৈতন্য), বিকস্বর কুত্রাপি-দ্রাবিড় সৈকত (পাঠক সমাবেশ), সাইক্লোন-মুহম্মদ জাফর ইকবাল (তাম্রলিপি), নিঝুম নিশিরাতে-ইমদাদুল হক মিলন (কথাপ্রকাশ), টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি এবং অন্যান্য-হাসনাত আবদুল হাই (আগামী), মহাচীনের মহাজাগরণ-সিরাজুল ইসলাম মুনির (অনন্যা), ড. এম ওয়াজেদ মিয়া-মাহফুজ সিদ্দিকী (কারুবাক), ধর্ম, ধর্মতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিনয় মিত্র, ইত্যাদি; ব্রাহ্মসমাজে চল্লিশ বৎসর-শ্রীনাথ চন্দ; ভূমিকা: যতীন সরকার (ইত্যাদি), ভারতবর্ষ এবং বাঙালির স্বশাসন (১ম খণ্ড) শেখ হাফিজুর রহমান (বাংলা একাডেমি), পরিবেশের প্রতিপক্ষ-মোকারম হোসেন (কথাপ্রকাশ)।
সারাবাংলা/এসএমএম/আইজেকে