Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রণোদনা প্রশংসনীয়, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে পৌঁছানো চ্যালেঞ্জ


৫ এপ্রিল ২০২০ ১৬:৫৫

ঢাকা: দেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের আঘাত মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রণোদনা প্যাকেজকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থনীতিদবিদরা। তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়েই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বাস্তবসম্মত একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। তবে এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে যারা প্রকৃত অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের কাছে যেকোনো মূল্যে এই অর্থ পৌঁছাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, এই অর্থ যেন লুটপাট না হয় এবং বড় বড় ব্যবসায়ীরা যেন এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) নামে এই সুবিধা নিতে না পারেন।

রোববার (৫ এপ্রিল) সকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের অর্থনীতিতে করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য এই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী প্যাকেজ ঘোষণায় বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৯ শতাংশ সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়া হবে। বৃহৎ শিল্প খাতের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এই সুদের অর্ধেক এবং এসএমই খাতের জন্য অর্ধেকেরও বেশি ভর্তুকি হিসেবে বহন করবে সরকার।

প্রধানমন্ত্রীর এই প্রণোদনা প্যাকেজকে স্বাগত জানিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জ্বা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কারণ করোনভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে এ ধরনের একটি প্রণোদনার খুবই প্রয়োজন ছিল। প্রধানমন্ত্রী সেটাই ঘোষণা করেছেন। তবে এই প্যাকেজের সঠিক বাস্তবায়ন সঠিকভাবে করতে হবে।

আরও পড়ুন- ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর

তিনি বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা কতটা সততার সঙেগ বিতরণ করা হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, সততার সঙ্গে এই অর্থ বিতরণ করতে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

মির্জ্জ্বা আজিজ বলেন, ব্যাংকগুলোর যে আর্থিক অবস্থা, তারা যদি আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ না পায়, তাহলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে এই অর্থ জোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। প্রণোদনা প্যাকেজের পুরো অর্থ উদ্যেক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরও বেড়ে যেতে পারে। সেজন্য এডিপি থেকে বরাদ্দ কাটছাট করে অর্থের সংস্থান করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার প্রস্তাব খুবই বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী। এই প্রণোদনা প্যাকেজ ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে ব্যয় করা হবে। এর মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য এবং ২০ হাজার কোটি টাকা এসএমই ও কুটির শিল্পের জন্য।

তিনি বলেন, এসএমই খাতই আমাদের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে। বর্তমানে এই খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই খাতে লাখ লাখ ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে ১০০ জনের কম লোক কাজ করছে। এরা মোট এসএমই খাতের ৮৩ শতাংশ। এ ধরনের উদ্যেক্তাদের কাছে প্রণোদনা প্যাকেজ পৌঁছানোই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আরও পড়ুন- সব শ্রেণির মানুষের জন্য ৪ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গর্ভনর বলেন, আমাদের টাকার কোনো অভাব হবে না। কিন্তু আমারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে কিভাবে পৌঁছাবে, সেটিই বড় বিষয়। কারণ তাদের অধিকাংশই ব্যাংকে আসেন না। ফলে এমনও হতে পারে, এসএমই উদ্যোক্তার নাম করে অন্যরা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিতে পারেন। যেটা যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রচুর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছে, যেমন— বিভিন্ন খামারি, ছোট ছোট নার্সারি, মুরগির খামার, অধুনিক কৃষক। তাদের কাছে পৌঁছনোটা চ্যালেঞ্জিং হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের ঘরে বসে থাকলে চলবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ের ডিভিশনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আতিউর রহমান বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য খাতের সংকট মোকাবেলা করতেই হবে। প্রয়োজনে বাজেট পুনর্বিন্যাস করে অথবা অন্য কোনোভাবে সমর্থন দিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বাজেটে ২০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার একটি তহবিল আলাদা করে রেখেছেন। সেটা থেকেও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা যায়।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সারাবাংলাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা সময়মতোই হয়েছে। এই অর্থ শুরু করার জন্য যথেষ্ট। আগামী তিন মাস এই অর্থ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।

আরও পড়ুন- করোনায় যা ক্ষতি, যা করণীয় জানালেন প্রধানমন্ত্রী

এদিকে, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছেও সহায়তা পৌঁছে দেওয়াকে চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, প্রণোদনার একটি বড় অংশ খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যয় করতে হবে। বিশেষ করে গরীব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। আর এটাকে ম্যনেজ করাই হবে বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ এখানে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি হয়। অতীতের অভিজ্ঞতাও তাই বলে। বর্তমানেও বিভিন্ন এলাকায় মেম্বার-চেয়ারম্যান এইসব অনিয়মে জড়িত। এ বিষয়ে সর্তক থেকে প্রয়োজনে স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে নাগরিক সমাজ এবং এনজিও গ্রুপের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে সহায়তা বিতরণ করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের খাবার আছে, কিন্তু খাবারের বণ্টনটা চ্যালেঞ্জ। করোনার আক্রমণে দেশের মানুষের একটি বড় অংশের খাবার কিনে খাওয়ার ক্ষমতা থাকবে না। সরকারকে তাদের জন্য খাদ্য কিনে সরবরাহ করতে হবে। বছরে আমাদের সাড়ে তিন কোটি টন খাবার লাগে। এই সময়ে সরকার কমপক্ষে ৫০ লাখ টন খাবার কিনে সারাদেশের গরীব মানুষের মাঝে সরবরাহ করতে হবে।

ব্যবসায়ীদের প্রণোদনার জন্য যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তাকেও যথেষ্ট মনে করছেন পিআরআই নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, শুরুর জন্য এই অর্থ যথেষ্ট। তবে এই অর্থ ব্যাংকের পাশাপাশি মাইক্রোফিন্যান্স ইনস্টিটিউটের মাধ্যমেও বিতরণ করতে হবে। কারণ অনেক ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা ব্যাংকে যেতে পারবেন না। মাইক্রোফিন্যান্সের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করলে সহজে তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এটাই চ্যালেঞ্জ। এই টাকা যেন আবার বড় বড় ঋণখেলাপিদের কাছে গিয়ে হাজির না হয়, সেটা দেখতে হবে।

আরও পড়ুন- প্রণোদনা প্যাকেজের অপব্যবহার নয়— হুঁশিয়ারি প্রধানমন্ত্রীর

ব্যাংকগুলোর ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্যাংকের হাতে বর্তমানে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ট্রেজারি বন্ড রয়েছে। এই ট্রেজারি বন্ডগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে নিতে পারে। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা বেড়ে যাবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রণোদনার বিকল্প নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। প্রধানমন্ত্রী যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, সেটিকে প্রাথমিক পদক্ষেপ বলেও মনে করছেন তিনি।

আবুল বারকাত সারাবাংলাকে বলেন, করোনা সংক্রামণকালীন প্রাথমিক প্রণোদনা প্যাকেজ হিসেবে এটি যুক্তিসঙ্গত প্যাকেজ। বর্তমান সময়ের জন্য এই প্যাকেজ প্রয়োজন রয়েছে। সামনে এর প্রয়োজন আরও বাড়বে, এই মুহূর্তে সেই টাকার অঙ্কটা বলা সহজ নয়। তবে এটি সর্বশেষ প্যাকেজ নয়। প্রণোদনার ক্ষেত্রে কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, চলতি মার্চ পর্যন্ত সময়ে আমাদের এডিপি‘র মাত্র ৪০ শতাংশ বরাদ্দ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। ফলে এই খাতে এখনো ১ লাখ ১৮ হাজার ২২৫ কোটি টাকা রয়ে গেছে। মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে এসে ভাউচার বানিয়ে টাকা খরচ দেখানো হয়। এই ভাউচার বানানোর সংস্কৃতি বন্ধ করে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা করোনা মোকাবিলায় ব্যয় করতে পারি আমরা।

অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব আবুল বারকাত আহসান এইচ মনসুর করোনাভাইরাস করোনার অভিঘাত ড. এ বি মির্জ্জ্বা আজিজুল ইসলাম প্রণোদনা প্যাকেজকে স্বাগত প্রণোদনা প্যাকেজ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর