চকবাজার ‘লকডাউন’ করে কাঁচাবাজার বসেছে প্যারেড মাঠে
১৭ এপ্রিল ২০২০ ১৯:০৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম কলেজের প্যারেড মাঠে চালু হয়েছে অস্থায়ী কাঁচাবাজার। অদূরে ব্যস্ততম চকবাজার কাঁচাবাজার আপাতত বন্ধ করে দিয়ে প্যারেড মাঠেই বাজার চালুর এ উদ্যোগ নিয়েছে নগর পুলিশের দক্ষিণ বিভাগ। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব রেখে ক্রেতার সমাগম এবং কেনাবেচা নিশ্চিত করতেই নগরীতে প্রথমবারের মতো কাঁচাবাজার সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
শুক্রবার (১৭ এপ্রিল) সকাল থেকে প্যারেড মাঠে এ কাঁচাবাজার চালু হয়েছে। শুরু থেকেই আশেপাশের অনেক বাসিন্দার সমাগম ঘটেছে অস্থায়ী বাজারটিতে।
নগর পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিএমপি কমিশনার স্যারের নির্দেশে আমরা বাজার বসানোর উদ্যোগ নিয়েছি। গতকাল (বৃহস্পতিবার) আমরা চট্টগ্রাম কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলি। উনারা ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার পর চকবাজার কাঁচাবাজার আপাতত বন্ধ করে দেওয়ার কাজ শুরু করি। কাঁচাবাজারটি তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আপাতত কোনো দোকানিরা বসতে পারবেন না। বাজারের আশপাশে ভ্রাম্যমাণ কোনো দোকানও বসতে পারবে না। বিষয়টি তদারক করবে স্থানীয় চকবাজার থানা।’
অস্থায়ী কাঁচাবাজারে কাঁচা তরিতরকারি, শাকসবজি, মাছ-মাংস থেকে শুরু করে ফলমূলও পাওয়া যাচ্ছে। সকালে প্যারেড মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, তিন শতাধিক দোকানি কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ ফুট দূরত্ব রেখে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ ভ্যানগাড়িতে শাকসবজি নিয়ে এসেছেন। কেউ কেউ আবার ত্রিপল টাঙিয়ে বানিয়েছেন অস্থায়ী দোকান। আর কেউ কেউ ত্রিপল-চৌকি নিয়ে ব্যস্ত দোকান সাজাতে। পুলিশ সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবকরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পণ্য কেনাবেচার বিষয়টি তদারক করছেন। কোথাও জটলা দেখলে দ্রুত গিয়ে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মো. আব্দুর রউফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘চকবাজার কাঁচাবাজার কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে আছেন। উনারা স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে আমাদের হেল্প করছেন। অস্থায়ী বাজারের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম করা হয়েছে। প্রত্যেক দোকান অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব মেনে বসবে। একইসময়ে একজন দোকানি একজনের বেশি ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন না। একজন ক্রেতার পণ্য কেনা শেষ হলে তিনি আরেকজনকে সুযোগ দেবেন। ক্রেতা প্যারেড মাঠের উত্তরের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকবেন, বের হবেন দক্ষিণের গেট দিয়ে। এটা আমাদের পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবেন। দোকানি কিংবা ক্রেতা যিনি-ই নিয়ম ভঙ্গ করবেন, আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
কথা হয় কয়েকজন দোকানির সঙ্গে। চকবাজার কাঁচাবাজারে সবজি বিক্রি করতেন মো. সাদেক। শুক্রবার তিনি ঢেড়স, লাউ, কচু, কচুর লতি, বেগুনসহ বিভিন্ন আইটেমের সবজি ভ্যানে নিয়ে বিক্রি করতে আসেন প্যারেড মাঠে। সাদেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) পুলিশ গিয়ে আমাদের বলেছে, আজ থেকে এখানে বসতে। সেজন্য এসেছি। আজ প্রথমদিন, তাই বেচাকেনা একটু কম। কাস্টমার তো আর সবাই জানে না। আস্তে আস্তে বাড়বে।’
চকবাজার কাঁচাবাজারের অদূরে ধুনিরপুল এলাকার শাক বিক্রেতা জসিম উদ্দিন শাক, সাজনা ডাটা, টমেটো নিয়ে এসেছেন প্যারেড মাঠে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলব। এটা তো আমাদের দায়িত্ব। বাঁচতে হলে তো এটা আমাদের করতেই হবে।’
নগর পুলিশের চকবাজার জোনের সহকারী কমিশনার রাইসুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চকবাজারে প্রায় ৩০০ স্থায়ী দোকানি আছে। ভ্রাম্যমাণ আছে আরও শ’খানেক। সবাইকেই প্যারেড মাঠে আসতে বলা হয়েছে। আপাতত প্রায় তিন’শজনের মতো বসেছেন। চকবাজারে এত ভিড় হয়, সেখানে কোনোভাবেই সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। সেজন্য ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকেই বড় মাঠে এনেছি।’
নগরীর বাকলিয়ার একাংশ, দেওয়ানবাজার, ডিসি রোড, জয়নগর, কাতালগঞ্জ, বাদুরতলা, কাপাসগোলাসহ বিভিন্ন এলাকার লাখো মানুষ প্রতিদিন বাজার করতে আসেন চকবাজার কাঁচাবাজারে। এসব এলাকা থেকে অনেকেই শুক্রবার এসেছেন প্যারেড মাঠেও। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নিজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এলাকায় মাইকিংসহ নানাভাবে প্যারেড মাঠে বাজার বসানোর বিষয়টি প্রচার করেছি। বাজার কমিটিও প্রচার করছে। সেজন্য অনেকেই বাজার করতে প্যারেড মাঠে এসেছেন। দিন যত যাবে, আরও আসবে। আপাতত এই বাজার চালু থাকবে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত।’
কথা হয় বাজারে আসা কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গেও। কেপি চাকমা চাকরি করেন ডায়াগনস্টিক সেন্টার শেভরণে। চকবাজারের বাসিন্দা কেপি সারাবাংলাকে বলেন, ‘চকবাজারে অনেক বেশি ভিড়। সেখানে সচেতনতামূলক কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগই নেই। সেই ভিড়ের মধ্যেই আতঙ্ক নিয়ে এতদিন আমাদের বাজার করতে হয়েছে। প্যারেড মাঠে বাজার হওয়ায় অনেক ভালো হয়েছে। এটা নিরাপদ।’
জয়নগর থেকে শামসুন্নাহার নামে এক গৃহিণী আসেন প্যারেড মাঠে বাজার করতে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাড়ির দারোয়ান সবসময় বাজার করে। এক সপ্তাহ ধরে সে-ও চকবাজারে যাচ্ছে না। সেকানে ভিড়ের মধ্যে যেতে সে ভয় পাচ্ছে। এখানে মাঠ বড়। অনেক মানুষ বাজার করতে এলেও ভিড় হবে না।’
চট্টেশ্বরী এলাকা থেকে সবিতা দাস নামে বেসরকারি হাসপাতালের এক স্বাস্থ্যকর্মীও আসেন বাজার করতে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজার সরানো হয়েছে বলে দামটা যেন বাড়তি না নেওয়া হয়, সেটা পুলিশ প্রশাসনকে দেখার অনুরোধ করছি।’
চকবাজার থানার ওসি মো. নিজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দাম বাড়তি নেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা মনিটরিং করব। কোনোভাবেই কাউকে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে দেওয়া হবে না।’
উপ-পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা আমরা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছি। এটা সুন্দরভাবে চললে সিএমপির দক্ষিণ বিভাগের অধীনে যেসব কাঁচাবাজারে বেশি ভিড় হয়, সেগুলো সরানোর উদ্যোগ নেব। আস্তে আস্তে পুরো নগরীতেই এই সিস্টেম চালু করলে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হবে।’