ভিন্ন এক রমজানের মুখোমুখি মুসলিম বিশ্ব
২৪ এপ্রিল ২০২০ ২২:২৭
ঢাকা: আকাশে রমজানের চাঁদ উঠে গেছে। রাত পেরোলেই শনিবার (২৫ এপ্রিল) থেকে শুরু মাহে রমজান মাস গণনা। এশার নামাজের পর তারাবির নামাজ, ভোরে সেহেরি আর সন্ধ্যায় ইফতার— একটি মাসের জন্য বাংলাদেশসহ মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর জনজীবনের রুটিনই বদলে যাবে। তবে বছর বছর যে রমজান মাস হাজির হয় মুসলিম উম্মাহ’র কাছে, এবারের রমজানটি তার তুলনায় আলাদা। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে সারাদেশে চলছে সাধারণ ছুটি। অনেক দেশেই চলছে লকডাউন। মসজিদে নামাজে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারাবির নামাজও হবে না জামাতে। রমজানজুড়ে আরও যত ধরনের আয়োজন হয়ে থাকে, গোটা মুসলিম বিশ্বকেই এ বছর সেসব আয়োজন থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে।
করোনাভাইরাসের কারণে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে যেসব থাকছে বিধিনিষেধ, তেমনি রোজা পালনের ক্ষেত্রেও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এমনিতেই রোজার মাসে ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত না খেয়ে থাকার কারণে বাকি সময়টিতে খাবার গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তারওপর এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এ সময়ে প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা। শরীর যেন কোনোভাবে দুর্বল না হয়, সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে।
মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে রমজান
সৌদি আরবে সব মসজিদে ওয়াক্তিয়া নামাজের জামাত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে আগেই। রমজানে মক্কা ও মদিনার প্রধান দুই পবিত্র মসজিদে অবশ্য তারাবির নামাজ জামাতে আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে মাত্র ১০ রাকাত তারাবি আদায় করা যাবে। সে নামাজও পড়তে পারবেন কেবল ওলামা ও মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ খাদেমরা। সাধারণ কোনো ব্যক্তি এই তারাবির নামাজের জামাতে অংশ নিতে পারবেন না।
রমজান মাসে সাধারণ মানুসের জন্য বন্ধ থাকবে ঐতিহাসিক আল-আকসা মসজিদের দরজাও। মক্কা-মদিনার দুই মসজিদের মতোই এখানেও কেবল মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিতরাই তারাবির নামাজে অংশ নিতে পারবেন। তারাবির জামাত অবশ্য অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
আল-আকসা মসজিদের পরিচালক শেখ ওমর আল-কিসওয়ানি বলছেন, ১৪শ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাদের। কঠিন এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হওয়ায় তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
করোনা পরস্থিতিতে জনগণের সুরক্ষায় মিশরে রমজান মাসেও রাত্রীকালীন কারফিউ বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি। একইসঙ্গে বন্ধ থাকবে মসজিদও। সেদিক থেকে কিছুটা শিথিলতা দেখাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। রমজানে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত লকডাউন শিথিল করা হয়েছে দেশটিতে। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম জানিয়েছেন, রমজানে প্রত্যেকের ঘরে খাবার নিশ্চিত করা তাদের প্রধান অগ্রাধিকার। এর জন্য করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত এক কোটি মানুষকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে দেশটি।
একই ধরনের বিধিনিষেধ রয়েছে ইন্দোনেশিয়াতেও। তবে সেখানকার রক্ষণশীল আচেহ প্রদেশে খানিকটা ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। শুক্রবার থেকে দেশটিতে রমজান শুরু হয়েছে। এর আগেই বৃহস্পতিবার আচেহ প্রদেশে স্বাভাবিক সময়ের মতোই মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় হতে দেখা গেছে। সেই নামাজে অংশ নেওয়া ফিতরাহ রিশকিয়া নামে একজন বলেন, আমি মাস্ক পরেছি, অন্যের থেকে দূরত্বও বজায় রেখেছি। তাই আমি উদ্বিগ্ন নই।
আরও পড়ুন: আকাশে রমজানের চাঁদ, রোজা শুরু কাল
মালয়েশিয়ার কেলানটান প্রদেশের শীর্ষ আলেম মোহাম্মদ শুকরি মোহাম্মদ অবশ্য রিশকিয়ার মতো নিরুদ্বিগ্ন হতে পারেননি। রমজানেও তিনি মসজিদে যাবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, জীবনে এই প্রথমবারের মতো মসজিদে যেতে পারছি না। তবে এই অপারগতাটুকু মেনে নিতে হবে। কারণ আমাদের সুরক্ষার স্বার্থেই সামাজিক দূরত্বের বিধি মেনে চলতে হবে।
করোনার আঘাতে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনিও জামাতে নামাজ না পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন সবার প্রতি। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেইয়ের মতো দেশগুলোতেও রমজান উপলক্ষে প্রতিবছর যেসব দোকানে বিশেষ বেচাকেনা হয়, সেগুলো বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
জামাতে তারাবিতে সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশেও
এপ্রিলের শুরুতেই ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। বলা হয়, মসজিদে জামাত চালু রাখার প্রয়োজনে খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা মিলে পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ অনধিক পাঁচ জন এবং জুমার জামাতে অনধিক ১০ জন শরিক হতে পারবেন।
রমজান মাস শুরুর আগেই তারাবির নামাজের ক্ষেত্রেও একই রকম নির্দেশনা জারি করা হয়। বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, রমজান মাসে মসজিদে এশার নামাজের জামাতে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিব, খাদেম ও ২ জন হাফেজসহ সর্বোচ্চ ১২ জন উপস্থিত থাকতে পারবেন। এই ১২ জনই এশার নামাজ শেষে তারাবি মসজিদে পড়তে পারবেন। বাকি মুসল্লিরা ঘরে তারাবির নামাজ পড়বেন।
রোজার দিনে খাবারে সতর্কতা
রোজা রাখলে স্বাভাবিকভাবেই ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দিনের সবচেয়ে বড় সময়েই কোনো খাবার খাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে এই করোনাকালে মাগরিবের সময় ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত সময়ে খাবার গ্রহণে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় খাবার না খাওয়ায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ফলে ইফতার থেকে সেহেরি পর্যন্ত এমন খাবারই খেতে হবে যেন শরীর সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারে।
সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট বা রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ ড. জেনা মাচিওচি বলেন, রোজার দিনে এমনভাবে খাবার খেতে হবে, যেন শরীরে শক্তির ভারসাম্য বজায় থাকে। এ ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাটের মতো ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট এবং ভিটামিন সি ও আয়রনের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টকে সুষম উপায়ে গ্রহণ করতে হবে। রঙিন শাক-সবজি, ফল, বিভিন্ন ধরনের ডাল ও বীজজাতীয় খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। তাছাড়া পানিশূন্যতা যেন তৈরি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
এছাড়া শরীরের রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা ধরে রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম ও হালকা ব্যায়ামের দিকে নজর দিতে বলেছেন ড. জেনা। তবে সবকিছুর ওপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে জনসমাগম এড়ানো, পারলে ঘরের বাইরে না যাওয়া, হাত ধোয়া ও হাঁচি-কাশি শিষ্টাচারের মতো সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাতেই গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি।
রোজার দিনে এসব স্বাস্থ্যবিধি এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানাও। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত ব্রিফিংয়ে তিনিও বলেন, যারা রোজা থাকবেন, তাদের ইফতারের পরের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। লেবু, আদা দিয়ে শরবত খেতে পারেন। গরম পানি দিয়ে গার্গেল করতে পারেন। তারাবির নামাজের ক্ষেত্রেও সরকারের নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলার আহ্বান জানান নাসিমা সুলতানা।
মুসলিম বিশ্বে রমজান মানেই উৎসব। সেহেরি আর ইফতার ঘিরে নানা আয়োজন তো আছেই, ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এই গোটা মাসটি জমজমাট থাকে সবক্ষেত্রেই। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সেই উৎসবের আমেজ একেবারেই কেড়ে নিয়েছে। ঠিক তেমন কথারই প্রতিফলন পাওয়া গেল ইন্দোনেশিয়ার গৃহিণী ফিতরিয়া ফামেলার কণ্ঠে। তিনি বলছেন, ‘এবারের রমজানটা একেবারেই আলাদা। এই রমজানকে কোনোভাবেই উৎসব বলা যায় না।’
স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়ার সময়
রমজানের আচার-উৎসবের এই শূন্যতায় গোটা মুসলিম বিশ্বই মিয়ম্রাণ হলেও এবারের রমজানকে মুসলিম উম্মাহর জন্য বড় একটি ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন ব্রিটিশ ফিজিওথেরাপিস্ট ও স্বাস্থ্যসেবা অধিকারকর্মী হেবা শাহিদ। তিনি বলছেন, এই রমজান মাসেই মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) সবার থেকে আলাদা হয়ে ইতিক্বাফে বসতেন। সবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে এক আল্লাহ’র নৈকট্য লাভের জন্য ইবাদতে মশগুল থাকতেন। ঠিক এবারের রমজানে করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুসলিমদেরও ঘরে থাকতে হচ্ছে। এই রমজানটি মাসটি তো তাই তাদের জন্য স্রষ্টার নৈকট্যলাভে নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের সুযোগ করে দিয়েছে। তাই ভিন্ন আঙ্গিকে হাজির হওয়া এই রমজান মাসকে মুসলিমরা উৎসবহীনতার হা-হুতাশ করে কাটাবে নাকি স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়ার প্রচেষ্টায় ইবাদতে মগ্ন হবে— সেই প্রশ্নই রেখেছেন হেবা শাহিদ।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, গার্ডিয়ান
তারাবির নামাজ মসজিদে নামাজ মুসলিম বিশ্ব রমজান রমজান মাস রোজা রোজায় খাবারে সতর্কতা