নমুনা সংগ্রহে থাকছে না আইইডিসিআর, ভোগান্তি বাড়ার আশঙ্কা
৩ মে ২০২০ ০২:৪৮
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে শুরুর দিকে নমুনা সংগ্রহ করে আসছিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানসহ সারাদেশের নমুনা সংগ্রহ করতো প্রথম দিক থেকেই।
রোববার (৩ মে) থেকে আর বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের কাজে যুক্ত থাকছে না আইইডিসিআর। সীমিত মাত্রায় নমুনা সংগ্রহ করলেও সেটা হবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যা এপিডমিওলজিক্যাল সার্ভের অংশ হিসেবে করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
নমুনা সংগ্রহের এই কাজ থেকে আইইডিসিআরের সরে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশে নতুনভাবে ভোগান্তিতে পড়তে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এখন থেকে বিভিন্ন বুথে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে সবাইকে আর এতে থাকছে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকিও।
বাংলাদেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘোষণার পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ল্যাবের সংখ্যা বাড়লেও প্রতিষ্ঠানটি বাসা থেকেই নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার পর তার ফলাফল জানাতো। রাজধানীতে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করা এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছিল নানা অভিযোগ। নমুনা সংগ্রহ ও নমুনা ফলাফল জানাতে দেরি করাসহ নানারকম অভিযোগ ছিল এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তবে তারা বাসায় গিয়েই নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসতো বলেও কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমাতো।
নমুনা সংগ্রহে দেরি করার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইইডিসিআর’র একটি সূত্র জানায়, আমাদের টিম বিভিন্ন স্থানে গিয়ে কাজ করে থাকে। তবে নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে তাদের বিপত্তির মুখে পড়তে হতো। বাসায় প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। এমনকি কিছু জায়গায় গাড়ি নিয়েও যাওয়া যেত না। সবকিছু মিলিয়ে সময় সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সামনের দিনগুলোতে তাহলে আইইডিসিআর কী কাজ করতে যাচ্ছে? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রতিষ্ঠানটির নির্ভরযোগ্য এক সূত্র বলেন, ‘আমরা আসলে টেস্ট কমিয়ে ফেলব এখন থেকে। আমরা একটা রেফারেল সিস্টেম হিসেবে কাজ করব। রিসার্চের জন্য টেস্ট করা হবে। সার্ভিল্যান্স হিসেবে টেস্ট করতে হবে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন আছে কিনা সেটা দেখার জন্য টেস্ট করব। আমরা এখন ওই দিকটায় বেশি যাব।’
সূত্র আরও বলেন, ‘রুটিন টেস্ট এখন হাসপাতালগুলো করবে। কারণ তাদের ডায়াগনসিসের জন্য এই টেস্ট জরুরি। আইইডিসিআর যে কারণে টেস্ট করছিল সেটা আসলে অনেক করা হয়েছে। আর তাই এখন আইইডিসিআর তাদের মূল কাজে ফিরে যাবে। সার্ভিল্যান্স ও কমিউনিটির এপিডমিওলজিক্যাল স্টাডির জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষা করা হবে।’
যেহেতু ক্যাপাসিটি আছে তাই নমুনা পরীক্ষা বন্ধ হবে না। যদি কোথাও স্যাম্পল জমে যায় সেক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সূত্র। তবে তারা রোববার থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ করবে না। এ বিষয়ে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরাকে জিজ্ঞেস করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে ৩ মে থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজে সম্পূর্ণরূপে সংযুক্ত থাকবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতর এরই মধ্যে নমুনা পরীক্ষার ল্যাবের সংখ্যা বাড়িয়েছে। দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রাজধানীসহ দেশের বেশকিছু স্থানে নমুনা সংগ্রহের জন্য বুথ বসিয়েছে। সেইসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে ল্যাব। সেসব ল্যাবে গিয়ে চাইলেই যে কেউ নমুনা পরীক্ষা করাতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে ওই কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে নমুনা জমা দিয়ে আসতে হবে।
তবে এ বিষয়ে এখনও কোনো বার্তা প্রচার করা হয়নি। আর তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ নাগরিকই জানে না, কোথায় গেলে নমুনা পরীক্ষা করানো যাবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বেনজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা হলো সমন্বয়হীনতার চূড়ান্ত রূপ। এতে করে জনগণের মাঝে হতাশা বাড়তে পারে। সেই হতাশা পরবর্তী সময় ক্ষোভে রূপ নেবে। কারণ এখন পর্যন্ত কোথায় গেলে নমুনা পরীক্ষা করানো যাবে সেটারই একটা রূপরেখা দিতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বল্প জনবল নিয়ে আইইডিসিআর যা করেছে তা তার সীমার বাইরে গিয়েই করেছে। তারা বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের যে কাজ করেছে তা তো স্বাস্থ্য অধিদফতরের করে দেওয়া প্রয়োজন ছিল।’
তিনি বলেন, ‘যেকোনো কিছুর পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্যানডেমিক মোকাবিলার জন্য সেই পরিকল্পনা হওয়ার দরকার সুদূরপ্রসারী। এক্ষেত্রে শুরু থেকেই স্বাস্থ্য অধিদফতর ব্যর্থ। তাদের কোনো বিভাগের সঙ্গে কারও সমন্বয় নেই। যে কারণে তারা শুরু থেকেই আইইডিসিআরের ওপর ভরসা করে গেছে। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানের কী সেই পরিমাণ জনবল আছে- সেই বিবেচনা তারা করেনি। এখনও তারা সরকারিভাবে নমুনা সংগ্রহ করার জন্য বুথ স্থাপন করতে পারে নাই। যেটা খুবই সহজ কাজ।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহের একটা সুবিধা ছিল। আর তা হলো- অন্তত সংক্রমণের ঝুঁকিটা কমে যেত। কিন্তু এখন যখন মানুষ জানবেই না কোথায় গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করানো যাবে তখন তারা দিকভ্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক বা বিভিন্ন স্থানে ঘুরবে। এর ফলে যদি কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধি পায় তবে তার দায় কে নেবে?’
এ দিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা নমুনা সংগ্রহ বুথ বিষয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে বুথ বসানোর অনুমতি দিয়েছে। ইতোমধ্যেই নারায়ণগঞ্জে ও গাজীপুরে আমাদের বুথ বসানো হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানেও বসানো হয়েছে বুথ। আরও বুথ আমরা স্থাপন করব। যেগুলো স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো বাদেও এখন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১১টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১১টি স্থানে আমরা বুথ বসানোর অনুমতি পেয়েছি। আমরা সেসব স্থানে পাওয়া নমুনা সংগ্রহ করে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন ল্যাবে পরীক্ষার জন্য জমা দিয়ে থাকি।
এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির কোনো আলাদা হটলাইন নম্বর বা যোগাযোগের কোনো মাধ্যম জানানো হয়েছে কি-না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের বুথে যারা আসবে তারাই নমুনা পরীক্ষা করাতে পারবে। আমাদের আলাদা কোনো নম্বর নাই। বুথ চলে গেলেই হবে।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে যেভাবে নমুনা সংগ্রহ করা হতো এখনও সেভাবেই হবে। আমাদের যেসব হটলাইন নম্বর দেওয়া আছে সেসব নম্বরে যোগাযোগ করা হলে নমুনা সংগ্রহ করা হবে। অর্থাৎ আইইডিসিআর যেভাবে নমুনা সংগ্রহ করতো সেভাবেই করা হবে।’
এর আগে অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএসএমএমইউ ও ঢামেকসহ নির্ধারিত ল্যাবগুলোতে গেলেই নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। বেসরকারিভাবে ঢাকার বিভিন্ন স্থানেও বসানো হচ্ছে নমুনা সংগ্রহ বুথ। এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে ব্র্যাকের পক্ষ থেকেও বেশকিছু স্থানে বসানো হচ্ছে নমুনা সংগ্রহের বুথ। সেসব স্থানে নমুনা সংগ্রহ করা হবে এবং সেগুলো বিভিন্ন ল্যাবে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’
কিন্তু এই নমুনা সংগ্রহের স্থানগুলো কোথায় বা যোগাযোগের উপায় কী? এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ডা.নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা চেষ্টা করব সব ল্যাব ও বুথে কীভাবে যোগাযোগ করা যায়, তা স্বাস্থ্য বুলেটিনে প্রচার করতে।’
তবে নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব পুরোপুরি স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। একাধিকবার এসএমএস পাঠানো হলেও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
আইইডিসিআর করোনা নমুনা সংগ্রহ বুথ ভোগান্তি ল্যাব স্বাস্থ্য অধিদফতর