গণমাধ্যমকর্মীদের অধিকার: সরকার, মালিক— ২ পক্ষের ভূমিকাতেই ঘাটতি
৩ মে ২০২০ ১৬:৩০
ঢাকা: চলছে করোনাকাল। এ ছাড়াও অনেক সময় আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা। আর মানুষ সৃষ্ট রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সভা-সমাবেশ, হরতাল, ধর্মঘট, অসহযোগ আন্দোলন, হামলা ইত্যাদি তো আছেই। এগুলোতে অনেক সময় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেন গণমাধ্যমকর্মীরা। অনেক সময় সাধারণ জনগণের জন্য বিমা, প্রণোদনা ও ঝুঁকিভাতার সু-সংবাদটিও প্রচার করেন তারা। কিন্তু অন্যদের অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরলেও নিজেদের অধিকারের কথা বলতে পারেন না গণমাধ্যমকর্মীরা। উল্টো চাকরি হারানোর ভয়ও থাকে তাদের। দুর্যোগে শত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে গেলেও তাদের অধিকারের বিষয়টি থাকে উপেক্ষিত। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিতদের জন্য ঝুঁকিভাতা থাকলেও সে সুবিধা নেই গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য।
গণমাধ্যমকর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট নয়। গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ‘সংবাদপত্র বেতন বোর্ড রোয়েদাদ’ এবং ‘সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ থাকলেও এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। নিয়মিতভাবে ‘সংবাদপত্র বেতন বোর্ড রোয়েদাদ’ বা ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করছে বহু প্রতিষ্ঠান— সরকারি তালিকায় এমন তথ্য থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করে। তবে বেশিরভাগ গণমাধ্যমকর্মীই ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন-ভাতা পান না। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি নেই বললেই চলে।
সাংবাদিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট রয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য আমি সবসময় পাশে আছি।’
আরও পড়ুন- স্বাধীন সাংবাদিকতার বাধা হামলা-মামলা, ছাঁটাই
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পত্রিকাগুলো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। অনেকে বকেয়া বিলের দোহাই দিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের বেতন দিচ্ছেন না। এক্ষেত্রে আমি বলব, এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সবগুলো মন্ত্রণালয় ও তাদের অধীনের দফতর-অধিদফতরগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে পত্রিকাগুলোর বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য। আশা করি, তারা বকেয়া বিল পেয়ে যাবেন।’
অন্যদিকে, করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগের সময় সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মতো গণমাধ্যমকর্মীদেরও ঝুঁকিভাতা বাস্তবায়নের দাবি সাংবাদিক নেতাসহ সংশ্লিষ্টদের।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মীদের ঝুঁকিভাতার বিষয়টি অবশ্যই কর্তৃপক্ষের চিন্তা করা উচিত। এই করোনা দুর্যোগের সময়ও গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।’
আরও পড়ুন- ‘মুক্ত, স্বাধীন ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয়’
তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রের জন্য গণমাধ্যমকর্মীরা কাজ করে। অন্যান্য সরকারি কর্মচারিদের মতো তাদের বিষয়টিও সরকারের দেখা উচিত। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে একজন গণমাধ্যমকর্মী যদি মারা যান তাহলে তার পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টপ্রতিষ্ঠান তার পরিবারের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, সেটি সরকারের দেখা উচিত।’
পাশাপাশি সংকটের এ সময়ে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য সরকারের সবধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
আমাদের নতুন সময় পত্রিকার সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘সময়ের আলো পত্রিকার নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবির খোকনের মৃত্যু প্রমাণ করে দিলো গণমাধ্যমকর্মীরাও করোনাযুদ্ধে সম্মুখ সমরে নিয়োজিত। এ পর্যন্ত কমবেশি অর্ধশত গণমাধ্যমকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে সরকারকে আমি ভাবতে বলব, সাংবাদিক নেতাদের ভাবতে বলব— আমাদের গণমাধ্যমকর্মীরা যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তাদের জন্য অন্তত ৫০ লাখ টাকার একটি জীবন বিমার ব্যবস্থা সরকারিভাবে করা যায় কি না। আর যারা অসুস্থ হয়েছেন তাদের কীভাবে সাহায্য করা যায় সেটা দেখতে হবে।’
এ ছাড়া এ সময় যারা বেকার বা কর্মহীন রয়েছেন তাদেরকে কীভাবে সাহায্য করা যায়, এমনকি গণমাধ্যমগুলোকে কীভাবে সাহায্য করা যায় সেটি নিয়ে ভাবার কথাও বলেন তিনি।
আরও পড়ুন- মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
ঝুঁকিবিমার বিষয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ঝুঁকি বিমা ওয়েজ বোর্ডে উল্লেখ আছে। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই সেটির বাস্তবায়ন নেই। এ বিষয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে আসছি। এই সময়ে মালিকদের ঝুঁকিভাতার বিষয়টি ঘোষণা থাকা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘যেকোনো বিপদের সময় যেসব পেশাজীবী কাজ করে, তাদের জন্য সাপোর্ট থাকে, এটি বিশ্ব স্বীকৃত। আমাদের এখানে না আছে মালিকের সাপোর্ট, না আছে সরকারের সাপোর্ট। আমরা আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য মাঠে কাজ করছি। আমাদের পেশাটা ভিন্ন। এ কারণে ঝুঁকি থাকার পর গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের পেশাগত দায়িত্ববোধ থেকে কাজ করছেন। এখানে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান মালিকের যদি সাপোর্ট না থাকে তাহলে সেটি আমাদের জন্য বিপজ্জনক।’ গণমাধ্যমকর্মীরা দেশের একজন নাগরিক হিসেবেও সহায়তা পাওয়ার অধিকার রাখে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সেক্রেটারিসহ আমরা কয়েকজন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। এই দুর্যোগে যারা ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন তাদের জন্য মন্ত্রীর কাছে আমরা বেশ কিছু দাবি জানিয়ে আসছি। আমরা বলেছি, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, বা আক্রান্ত হন তাহলে তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইনসেনটিভ ঘোষণা করেছেন। গণমাধ্যমকর্মীরাও করোনায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। এরই মধ্যে আমাদের একজন সহকর্মী মারা গেছেন। যারাই করোনায় আক্রান্ত হবেন তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইনসেনটিভ দাবি করেছি। মন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, কল্যাণ ফান্ডের মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতার চেষ্টা করবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমগুলোর মালিকদের কাছে আমাদের দাবি, কর্মীদের নিরাপদে রেখে কাজ করার সুযোগ দিন। আর যাদেরকে মাঠে যেতেই হয় তাদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’