প্রণোদনা দ্রুত, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার দাবি: গবেষণা
৭ মে ২০২০ ২১:৪৮
ঢাকা: চলমান কোভিড-১৯ মহামারী বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাতে বিপর্যয় ঠেকাতে সরকার ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজকে দ্রুত, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার দাবি ট্রেড ইউনিয়নের। ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)’র ‘র্যাপিড রিসার্চ রেসপন্স টু কভিড-১৯’ এর অংশ হিসাবে করা গবেষণায় উঠে এসেছে এই ফলাফল।
বৃহস্পতিবার (৭ মে) বিআইজিডি আয়োজিত ওয়েবিনারে গবেষণার ফলাফল ও সুপারিশসমূহ তুলে ধরা হয়।
শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং তৈরি পোশাক শ্রমিকদের উপর প্রণোদনা প্যাকেজের প্রভাব সম্পর্কে শ্রমিকনেতাদের মূল্যায়ন তুলে ধরা এই গবেষণার উদ্যেশ্য ছিল।
গবেষণায় কারখানা-ভিত্তিক ও জাতীয় শ্রমিক সংগঠনগুলো থেকে মোট ২০ জন (১০ জন নারী ও ১০ জন পুরুষ) শ্রমিকনেতার নিবিড় গুণগত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি, প্রণোদনার গাইডলাইনসহ বিভিন্ন গবেষণাপত্র, সংবাদপত্র, অন্যান্য প্রিন্ট ও ডিজিটাল মাধ্যম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণায় উঠে এসেছে, বেশিরভাগ ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজকে ‘সময় উপযোগী পদক্ষেপ’ হিসেবে প্রশংসা করেন। সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে প্যাকেজটি মজুরি ও চাকুরীর অনিশ্চয়তা দূর করে শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘব করবে বলে তারা মনে করেন।
তবে ‘প্রণোদনা প্যাকেজের পর্যাপ্ততা’ নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন।
তারা প্রশ্ন তোলেন, এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে কি এ খাতের সকল শ্রমিকর শতভাগ বেতন-ভাতা দেওয়া সম্ভব হবে? আমাদের হিসেবে, প্রণোদনা প্যাকেজ তিন মাসের মজুরির জন্যে প্রয়োজনের মাত্র ৫১ ভাগ পূরণ করবে। কীভাবে এ ঘাটতি পূরণ করা হবে সেটি এখনও পরিষ্কার না। তবে এও বলা হচ্ছে যে, সব কারখানার প্রণোদনা প্যাকেজ দরকার হওয়া সমীচীন না; উত্তরদাতারা জোরালো মত প্রকাশ করেন যে, বহু কারখানার মালিকদের নিজেদেরই কয়েক মাসের মজুরি দিতে পারা উচিত।
একজন শ্রমিক প্রতিনিধি মনে করেন, ‘বেতন না দিতে পারা মালিকদের সামর্থ্যের প্রশ্ন নয়, এটা তাদের মানসিকতার প্রশ্ন।’
উত্তরদাতাদের মতে, প্রণোদনা বাস্তবায়নে ‘প্রয়োজনভিত্তিক নীতির ঘাটতি’ আছে। ছোট-বড় সব কারখানার মালিক তহবিলের জন্যে আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন; অথচ ছোট কারখানা যাদের শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের সহযোগিতা বেশি দরকার। শ্রমিক নেতারা মনে করেন, বাস্তবে মালিক সমিতির তালিকাভুক্ত সদস্য এবং বড় বড় কারখানা সরকারি যে কোনো সুযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে।
আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে যে, প্রণোদনা প্যাকেজ বলা হলেও এটা আসলে ঋণ। এটি অনুদান কিংবা ভর্তুকি নয়। সুতরাং একটা ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে যে, কারখানার মালিকেরা হয়ত ঋণের আবেদনের পরিবর্তে কারখানা বন্ধ কিংবা শ্রমিক ছাঁটাই করা শ্রেয়তর মনে করতে পারেন। শ্রমিককে আসলে কত টাকা দেওয়া হবে তা নিয়েও শ্রমিক নেতাদের মাঝে উদ্বেগ রয়েছে। যদি শ্রমিকদেরকে নিয়মিত মজুরির চেয়ে কম দেওয়া হয়, সেটা তাদের টিকে থাকার জন্যে যথেষ্ট হবে না।
প্রণোদনা প্যাকেজে বাস্তবায়নের সম্ভাব্য কিছু ফাঁক-ফোকর এবং সীমাবদ্ধতা গবেষণায় উঠে এসেছে। এ প্যাকেজ যদিও সব শ্রমিকের জন্যে, তবুও কিছু নির্দিষ্ট শ্রমিকশ্রেণি প্যাকেজ থেকে বাদ পড়তে পারে। যেমন, চুক্তিভিত্তিক কিংবা শিক্ষানবিশ শ্রমিক নিয়মিত কর্মীদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত নয়, ফলে এরা প্রণোদনা প্যাকেজের আওতার বাইরে থেকে যেতে পারে। ছোট ছোট কারখানার শ্রমিকেরাও এই প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
কারণ প্রথমত এসব কারখানার ব্যাংকের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক নাও থাকতে পারে; দ্বিতীয়ত এগুলো বিজিএমইএ বা বিকেএমই’র তালিকাভুক্ত নয়; তৃতীয়ত এখানে হয়তো শ্রমিকের নুন্যতম বেতন-ভাতা দেওয়ার আইন মানা হয় না, তাই মালিকেরা তথ্য প্রকাশে ভয় পেতে পারেন; চতুর্থত বড় কারখানার কাজ সাব-কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে করছে এবং নিজেরা সরাসরি পোশাক রফতানি করে না।
অনেক শ্রমিকের ব্যাংক কিংবা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে কারিগরি সীমাবদ্ধতা ও ভৌগোলিক বাধার কথা উল্লেখ করেন।
৩ মে’র মধ্যে প্রায় ৩ মিলিয়ন শ্রমিক মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খুলেছে, তবু এখনো বহু শ্রমিক মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের আওতার বাইরে রয়েছে।
অনেক উত্তরদাতা বলেছেন যে, মালিকদের প্রতি শ্রমিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের বড় ধরনের বিশ্বাসের ঘাটতি আছে। প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে অর্থগ্রহণের ব্যাপারে স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, পরবর্তীতে যাতে ওই সব কারখানার শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের বাস্তব চিত্র পরীক্ষা করা যায় এবং প্রণোদনার সমতাভিত্তিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায়।
গবেষণায় এটা খুব জোরালোভাবে এসেছে যে, পুরো প্রক্রিয়ায় পর্যালোচনা ও তদারকি প্রক্রিয়ার ঘাটতি রয়েছে।
কারখানার মালিকেরা প্রণোদনার অর্থ অপব্যবহার করতে পারেন সেকথাও উঠে এসেছে। প্রথমত কারখানার স্টাফ যেমন লাইন সুপারভাইসর অথবা লাইন চিফদেরকে শ্রমিকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, দ্বিতীয়ত শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি দেখিয়ে, এবং তৃতীয়ত ভুয়া শ্রমিকদের তালিকা এবং ভুয়া মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট তৈরি করে তারা প্রণোদনার অপব্যবহারে চেষ্টা চালাতে পারেন বলে অনেক উত্তরদাতা মনে করেন।
ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা মালিকপক্ষকে শ্রমিকদের বিশ্বাস না করার পেছনে নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন। মালিকেরা যেন এই প্রণোদনা শ্রমিকদের সুবিধার জন্যে মনে না করে। বরং অল্প সুদে ঋণের একটা উৎস হিসেবে মনে করতে পারেন। অতীতে মালিকদের ‘শ্রমিক বিরোধী মানসিকতা’র বহিঃপ্রকাশ এবং পাশাপাশি সরকারের ত্রাণ, পুনর্বাসন কার্যক্রমসহ বিভিন্ন প্রণোদনা ও সুযোগ সুবিধা বিতরণের ক্ষেত্রে অপব্যবহার এবং তসরুপের প্রবনতারোধ করতে না পারার প্রবণতার কারণে শ্রমিকরা বিশ্বাস হারিয়েছে বলে উত্তরদাতার মনে করেন।
সরকার ও তৈরি পোশাক মালিকদের নিবিড় রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকায় এ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাবহার করার বিষয়েও তারা দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করেছেন।
ওয়েবিনারে গবেষণার ফল তুলে ধরেন গবেষক দলের প্রধান ও বিআইজিডির সিনিয়র ফেলো অব প্র্যাকটিস মাহীন সুলতান।
বিআইজিডির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. ইমরান মতিনের পরিচালনায় ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আকতার, আওয়াজ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নাজমা আক্তার, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আক্তার, ডিআইএফই এর ডিআইজি মুস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিকেএমইএর পরিচালক ফজলে শামিম এহসান, গবেষক মো. শাহনেওয়াজ হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, কবিতা চৌধুরী, জান্নাতুন নাঈম, ফারাহ হক, দেশের তৈরি পোষাক খাতের শ্রমিক নেতা সহ গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা।