‘চিকিৎসক হয়েও বাবাকে বাঁচাতে পারিনি’
৯ মে ২০২০ ২২:১৮
ঢাকা: ‘প্রতি সপ্তাহে তিনবার বাবার কিডনি ডায়ালাইসিস করাতে হতো। ৭ মে তাকে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে যাই কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য। কিন্তু হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে প্রেসার কমানোর ওষুধ দিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে বলে বাবাকে। তবে আমার মনে হচ্ছিল, উনাকে বাসায় নেওয়া ঠিক হবে না। তাই বাবাকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটতে থাকি। ইউনাইটেড, স্কয়ার, আনোয়ার খান মডার্ন, রিজেন্টসহ আশেপাশের সব হাসপাতালেই তাকে ভর্তির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সবাই বলে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করিয়ে আনার জন্য। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও ভর্তি রাখা হয়নি। পরবর্তী সময়ে এক আত্মীয়ের সূত্র দিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করাই। তার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) সেবা দরকার ছিল খুবই। কিন্তু সেটা দিতে পারিনি। সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। চিকিৎসক হয়েও বাবাকে বাঁচাতে পারিনি।’- কথাগুলো বলছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারের মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ।
শনিবার (৯ মে) বেলা ১২ টার দিকে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গৌতম আইচ সরকার। করোনাকালে বাবাকে নিয়ে চিকিৎসা বিড়ম্বনার কথা এভাবেই বলছিলেন তার মেয়ে।
ডা. সুস্মিতা আইচ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবার কিডনির সমস্যার কারণে ডায়ালাইসিস করাতে হতো। ওই সময় প্রায়ই প্রেসার বেড়ে যেত, শ্বাসকষ্ট হতো ও লাংয়ে পানি চলে আসতো। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কোনো উপসর্গ না থাকলেও ডায়ালাইসিসের জন্য বাবাকে কোথাও ভর্তি করা হয়নি। পরে খুব কষ্টে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করি। কোভিড-১৯ উপসর্গ না থাকায় সেখানে তাকে আলাদা একটি কেবিনে রাখা হয়। শুক্রবার সারাদিনও সেখানে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানো হয়নি। পরে শনিবার তিনি মারা যান।’
ডা. সুস্মিতা বলেন, ‘চিকিৎসক পরিচয় দিয়েই আমি কথা বলি সবখানে। বাবার জন্য যদি খুব দ্রুত আইসিইউ সেবা নিশ্চিত করতে পারতাম তবে তাকে বাঁচাতে পারতাম। উনার চিকিৎসাই হলো না। চিকিৎসক হয়েও বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না।’
সরকারের স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া ৩৩৩ হটলাইনে দায়িত্ব পালন করেন গৌতম আইচের কন্যা ডা. সুস্মিতা আইচ। ‘৩৩৩ থেকেও কী কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি?- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. সুস্মিতা আইচ বলেন, ‘আমি সেখানে জব করি। কিন্তু আমি সেখানে ফোন দিইনি।’
ডা. সুস্মিতা যখন সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তার বাবাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এখন এই সময়ে আমি আর কথা বলতে পারছি না। এখন বাবার মরদেহ নিয়ে যাচ্ছি। উনাকে অনেক হাসপাতালেই নেওয়া হয়েছিল। ইতোমধ্যেই আমার ওপর প্রেশার ক্রিয়েট করা হয়েছে যে, মিডিয়াতে যেন কথা না বলি। এসব নিয়ে আমি বিব্রতকর অবস্থায় আছি।’
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গৌতম আইচ সরকার দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। উনার ওপেন হার্ট সার্জারিও হয়েছিল। প্রায় এক বছর ধরে উনি বাসাতেই ছিলেন। অফিসে তেমন আসতে পারতেন না অসুস্থতার জন্য। তবে আমাদের জানা মতে, উনার কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তেমন কোনো সমস্যা ছিল না।’
মৃত্যুর আগে শ্বাসকষ্ট থাকলেও সেটা কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে হয়নি জানিয়ে সচিব বলেন, ‘উনার প্রতি সপ্তাহে তিনবার কিডনি ডায়ালাইসিস করার প্রয়োজন হতো। ৭ এপ্রিল তিনি ল্যাব এইড হাসপাতালে যান কিডনি ডায়ালাইসিস করতে। তবে সেখানে তাকে ভর্তি করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে তাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অবস্থা বেশি খারাপ হলে তার স্ত্রীসহ পরিবারের লোকজনই তাকে আইসিইউতে নিতে দেননি। কারণ আইসিইউতে ওই সময় কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী ছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমি চিকিৎসকের সঙ্গেও কথা বলেছি। তার পরিবারেরও ধারণা, তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত ছিলেন না ‘
এদিকে কিডনি ডায়ালাইসিসের রোগী ভর্তি না নেওয়া বিষয়ে ল্যাব এইড হাসপাতালের হেড অব অপারেশন মো. আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে পূর্ণ তথ্য আমার জানা নেই। তবে যদি রোগীর কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কোনো উপসর্গ বা জ্বর থাকে তখন তাকে ভর্তি না করানোর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেই গাইড লাইন দেওয়া আছে। যাদের জ্বর আছে তাদের জন্য আলাদা হাসপাতাল রয়েছে। উনারা যদি রোগীর টেস্ট করাতেন। আর টেস্টের ফলাফল যদি নেগেটিভ থাকতো তাহলে অবশ্যই তাকে ভর্তি করানো হতো।’
সংকটাপন্ন অবস্থায় রোগীর টেস্ট করিয়ে ফলাফল এনে চিকিৎসা নেওয়া কি সম্ভব?- এমন প্রশ্নের উত্তরে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কোভিড-১৯ উপসর্গ যদি থাকে তবে তাকে আমরা নেব না। আমাদের চিকিৎসকদের কাছে নিশ্চয় সেই সাইন সিম্পটম মিলেছে। তাই উনাকে ভর্তি করা হয়নি।’
কিডনি ডায়ালাইসিস কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল কোভিড-১৯ উপসর্গ চিকিৎসক টপ নিউজ বাবা মৃত্যু ল্যাব এইড