টেলিভিশনে পাঠবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য আসছে রেডিও-মোবাইলে ক্লাস
৮ জুন ২০২০ ১১:০২
ঢাকা: পটুয়াখালীর প্রত্যন্ত একটি গ্রাম কমলাপুর। এখানকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী দীপ্তি রায় (১০)। করোনা বিস্তার রোধে তার স্কুল প্রায় তিনমাস ধরে বন্ধ। এই সময়ে পড়াশুনা বলতে গেলে শিকেয় উঠেছে। মায়ের সঙ্গে টুকটাক কাজে সহযোগিতা আর খেলাধুলা ছাড়া আর কিছু করে না দীপ্তি। তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। তাই বাড়িতে টেলিভিশন নেই। সস্তা দামের স্মার্টফোন বাড়িতে একটা থাকলেও ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে পড়াশুনার পদ্ধতি জানে না বাড়ির কেউ।
এদিকে একই জেলার মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দাসপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীই অনলাইন কিংবা টেলিভিশনেও পাঠ নিতে পারছে না। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনিসুর রহমান জানান, তারা শিক্ষার্থীদের সংসদ টেলিভিশন দেখে ক্লাস শোনার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে সেই পরামর্শ কতটা কাজে লাগছে তা জানেন না তিনি।
অন্যদিকে শহরের বিদ্যালয়গুলো এ বিষয়ে এগিয়ে। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক গাজী আশরাফ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তারা ফেসবুকের মাধ্যমে পাঠদান করেন। সেখানে ভিডিও আপলোড করে দেওয়া হয়। আবার অনেক শিক্ষক ফেসবুক লাইভে ক্লাস নিচ্ছেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করছে এবং শিক্ষক সেই প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছেন।
এছাড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রায় তিনমাস মাস ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তবে শিক্ষার্থীরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে সেজন্য সরকারি টিভি চ্যানেল সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের বিকল্প হিসেবে পঠনপাঠন দিচ্ছে। আবার অনেক বিদ্যালয় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন। কিন্তু এসব সুবিধা কেবল শহরের শিক্ষার্থীরাই বেশিরভাগ পেয়ে থাকে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ওয়েবসাইটের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৬০১টি। এই বিদ্যালয়গুলোর ২ কোটি ১৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৩৮ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করে থাকেন ৩ লাখ ২২ হাজার ৭৬৬ জন। বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৯৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। উপবৃত্তি সুবিধা পায় ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী। ২০১৫ সালের তথ্যানুযায়ী ঝড়ে পড়ার হার ২০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। শিক্ষাখাতের এই অর্জন ধরে রাখতে চায় সরকার। তাই শিক্ষার্থীদের ক্লাসের পড়া পুষিয়ে দিতে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, দেশের ৫৪ শতাংশ মানুষের ঘরে টেলিভিশন রয়েছে। আর ক্যাবল নেটওয়ার্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, তাদের নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকা টেলিভিশন সেটের সংখ্যা চার কোটির মতো। অন্যদিকে বিটিআরসি জানাচ্ছে, দেশে মোট ১৬ কোটি ৬১ লাখ মোবাইল সংযোগ রয়েছে। আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৪২ লাখ। আর ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে তিন কোটির মতো।
সরকার এবার শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠদান পৌঁছে দিতে এই নেটওয়ার্ক কাজে লাগাতে চায়। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম আল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে যে পাঠদান হচ্ছে তা গ্রামাঞ্চলের সিংহভাগ শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না- এমন তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। তাই টেলিভিশনের পাশাপাশি রেডিও এবং মোবাইলের মাধ্যমে পঠনপাঠন পৌঁছাতে একটা প্লাটফরম তৈরি করছি। এজন্য ক্লাস রেকর্ড করা হচ্ছে। এগুলো ধারাবাহিকভাবে রেডিও এবং মোবাইলে সম্প্রচার করা হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীর মায়েদের কাছে এ বিষয়ে এসএমএস পাঠানো হবে। এতে করে ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থীকে অনলাইন পাঠদানের আওতায় আনা যাবে।’
তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। ছয় মাসের জন্য স্বল্প, এক বছরের জন্য মধ্য এবং দেড় বছরের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। গ্রীষ্ম ও রমজানের ছুটির আগে ১৭ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এতে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৪৩৬টি ক্লাস হয়নি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ৬৮টি, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৬৮টি এবং তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ১০০টি করে ক্লাস নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হওয়া এই ক্লাসগুলো কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায় সেই পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে কোভিড-১৯ বাড়ছে। সেটার ওপরে ভিত্তি করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে।
আকরাম আল হোসেন বলেন, ‘আমরা জানি দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর ঘরে টেলিভিশন নেই। প্রাথমিকভাবে আমরা সংসদ টিভির মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের বিকল্প ক্লাস শুরু করেছি। পাশাপাশি ইন্টারনেটের মাধ্যমেও চেষ্টা করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে দেখা গেছে দেশের বড় একটা অংশ এ সুবিধা পাচ্ছে না। যারা টেলিভিশন দেখতে পায় না, সেই সংখ্যাটা কত সে বিষয়ে সমীক্ষা করতে চিঠি পাঠিয়েছি। প্রত্যেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এই তথ্য সংগ্রহ করবেন। কয়জন শিক্ষার্থীর বাড়িতে টেলিভিশন আছে, কারা সংসদ টিভির ক্লাস দেখতে পায় না, কাদের স্মার্টফোন নেই- এসব তথ্য সংগ্রহ করে পরবর্তী উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
এদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থাও একই রকম। একাধিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, নানা কারণে তারা টেলিভিশনে ক্লাস দেখতে পারে না। কারও বাড়িতে টেলিভিশন নেই; আবার যাদের বাড়িতে আছে সেখানে ক্লাসের সময় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ঠিক মতো ক্লাস দেখতে পারে না। তবে যেসব শিক্ষার্থীরা টেলিভিশনের পাঠদান সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের তালিকা তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট স্কুল কলেজের প্রধান শিক্ষক/অধ্যক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। সেসব তথ্য এলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
মাউশির তথ্যানুযায়ী, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৭৫ লাখ ১০ হাজার ২১৮ জন। আর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৮৫১ জন। মাদরাসা শিক্ষার্থী ৭০ হাজার ৯৯৮ জন। টিচার এডুকেশনে পড়ছে ৩৮ হাজার ৬৯১ জন শিক্ষার্থী। আর কারিগরি শিক্ষায় রয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৫৫৬ জন শিক্ষার্থী। এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য তাদের কাছে পাঠদান পৌঁছে দিতে দেশের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের রেকর্ড করা পাঠদান সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। তারপরও দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষার্থী সে সুবিধা পাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে সরকার শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দিতে যে ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে মনে হয়, আমরা ডিজিটাল বৈষম্যের চাবিকাঠি তৈরি করে ফেলেছি। কারণ এই অনলাইন কিংবা টেলিভিশনের মাধ্যমে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার সুবিধা কিছু শিক্ষার্থী পাচ্ছে; আবার কিছু শিক্ষার্থী মোটেই পাচ্ছে না। এতে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে সুবিধার বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরা ঝরে যাবে। তবে এর বাইরে বিকল্প চিন্তা করতে হবে।’ এক্ষেত্রে বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারের পাশাপাশি রেডিও এবং মোবাইল ফোনকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি।
টেলিভিশন মাধ্যমে পাঠদান অনেক বেশি অর্থবহ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি বিদ্যালয়ে টেলিভিশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেখানে যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী টিউশনি করে তাদের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক ছোট ছোট ভিডিও বানিয়ে টিভিতে প্রচার করা যেতে পারে। এতে করে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে, পাশাপাশি টিউশন থেকেও বেরিয়ে আসা যাবে।’
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা জানি সকল শিক্ষার্থীর কাছে এভাবে পাঠদান পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি বাংলাদেশ, সেরকম পরিস্থিতি আগে কখনও আসেনি। সেজন্য প্রতিটি বিষয়ই শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন। এসব বিষয়কে মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও কীভাবে পাঠদান পৌঁছে দেওয়া যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, ‘গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হলে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তর মিলিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীর লেখাপড়া ক্ষতি হচ্ছে এ অচলাবস্থার কারণে।
অনলাইনে পাঠদান করোনাভাইরাস গ্রামাঞ্চল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ