চট্টগ্রামে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে চলছে ‘তামাশা’, ফল পেতে ১৫-২০ দিন
২২ জুন ২০২০ ১১:৩৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষার জন্য গত ৩১ মে নমুনা দিয়েছিলেন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোমিন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরদিন তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসা নিয়ে ৯ জুন সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন তিনি। ১৪ জুন আবার নমুনা দেন পরীক্ষার জন্য। উভয় পরীক্ষার প্রতিবেদন আসে ২০ জুন। ৩১ মে’র নমুনায় কোভিড-১৯ পজিটিভ এবং আরেকটিতে নেগেটিভ আসে। নমুনা দেওয়ার পরের দিনের পরদিন প্রতিবেদনের অপেক্ষায় থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মোমিন।
একইভাবে মোমিনের স্ত্রী নাজমুন নাহারেরও নমুনা দেওয়া হয় ৩১ মে ও ১৪ জুন দুই দফায়। সেই প্রতিবেদনও আসে ২০ জুন। ৩১ মে’র নমুনায় আসে নেগেটিভ আর ১৪ জুনের নমুনায় পজিটিভ। নাজমুনের শরীরে কোনো উপসর্গ নেই। কিন্তু পরীক্ষায় করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ায় তিনি আইসোলেশনে আছেন। আব্দুল মোমিন সারাবাংলাকে জানান, নমুনা প্রতিবেদন নিয়ে বিভ্রান্তিতে তাদের পরিবারকে উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যে কাটাতে হচ্ছে।
জ্বর-শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ফিলিপাইনের নাগরিক রুয়েল ই কাতানের নমুনা নেওয়া হয় গত ৩ জুন। পরদিন তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। চট্টগ্রাম বন্দরের বেসরকারি বার্থ অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেক কোম্পানিতে কর্মরত রুয়েল গত ১৯ জুন রাতে মারা যান। তার নমুনা প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ফিলিপাইন কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের চিফ অব স্টাফ শেখ হাবিবুর রহমান।
কক্সবাজার সদরের বাসিন্দা বৃষ্টি চৌধুরী, তার মা শেলী চৌধুরী ও ভাই শাকিল চৌধুরী গত ৭ জুন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে নমুনা দেন। তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হলে শেলী ও শাকিলকে ৯ জুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১০ জুন আবার দুজনের নমুনা নেওয়া হয়। ওইদিন কক্সবাজার থেকে নমুনা প্রতিবেদন আসে, শেলী ও শাকিল নেগেটিভ এবং বৃষ্টি পজিটিভ। ২০ জুন চমেকের ল্যাবের প্রতিবেদন আসে, শেলী ও শাকিল দুজনই পজিটিভ। বৃষ্টি চৌধুরীর বক্তব্য, তার মা ও ভাইয়ের অবস্থা এত খারাপ ছিল দু’জনকে প্রতিদিন ২৫ লিটার করে অক্সিজেন দিতে হয়েছে। কক্সবাজার ল্যাবের রিপোর্টকে সঠিক ধরে যদি তাদের চিকিৎসা না করা হতো, তাহলে মা-ভাইকে বাঁচানো যেত না।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা থেকে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষা করা হয় কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে।
চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান এলাকার বাসিন্দা তুষার দে ও কাজল দে গত ৬ জুন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বুথে নমুনা দেন। রোববার (২১ জুন) পর্যন্ত তারা নমুনার রিপোর্ট পাননি।
মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রামে জনস্বাস্থ্য নিয়ে নাগরিক আন্দোলনে যুক্তরা বলছেন, নমুনা পরীক্ষার নামে চট্টগ্রামে তামাশা চলছে। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কথা অস্বীকার করছেন না স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও। তবে অসহায়ত্ব প্রকাশ ছাড়া সমাধানের কোনো পথ দেখাতে পারছেন না তারা।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, নমুনা দিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন কিংবা তারও বেশি সময় পার না হওয়া পর্যন্ত মিলছে না রিপোর্ট। প্রতিদিন সংগ্রহ করা অন্তত ৬০০ রোগীর নমুনা ফেলে রাখা হচ্ছে। নমুনা হারিয়ে যাওয়া অভিযোগও আসছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন ৮০০ নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা আমাদের আছে। বিদ্যমান জনবল ও পিসিআর মেশিন দিয়ে সেটা করতেও কষ্ট হবে। তারপরও পারি। কিন্তু প্রতিদিন নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৪০০। এত নমুনা তো আমরা একদিনে পরীক্ষা করতে পারব না। অনেক পেশাজীবী সংগঠন, এনজিওর পক্ষ থেকে বুথ স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এত নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে, যা পরীক্ষা করা আমাদের সক্ষমতার বাইরে। সেসব বুথে অনেকে তদবির করে নমুনা পরীক্ষার জন্য দিয়ে যাচ্ছেন। কিটের অপচয় হচ্ছে। কিটের সংকটও আমাদের আছে।’
করোনা মোকাবিলায় গঠিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কারী ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বুথ চালু করা এটা চট্টগ্রামে একটা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। যে যেভাবে পারছেন বুথ বসিয়ে নমুনা নিচ্ছেন। অনেকে তদবির করে কিংবা প্রভাব খাটিয়ে নমুনা দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, উনার শরীরে করোনার উপসর্গ নেই। এত নমুনা পরীক্ষার সুযোগও নেই। ফলে ভবিষ্যতে নমুনাজট আরও বাড়বে।’
চট্টগ্রামে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি পাঁচটি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সাইন্সেস ইউনিভার্সিটি (সিভাসু), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ল্যাব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাব ও বেসরকারি ইমপেরিয়াল হাসপাতাল। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবেও চট্টগ্রামের কিছু নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নমুনার চাপ বেড়ে যাওয়ায় তিন হাজার নমুনা ঢাকায় পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৮০০ নমুনার প্রতিবেদন গত ১৯ ও ২০ জুন পাওয়া গেছে। এক হাজার ২০০ নমুনা প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি।
বিআইটিআইডি’র ল্যাব ইনচার্জ অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের মেশিনের নমুনা পরীক্ষার সর্বোচ্চ সক্ষমতা ২০০। কিন্তু আমরা ২৫০ পরীক্ষা করছি। আমাদের এত লোকবল নেই যে আরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করব। আমাদের মেশিনেরও সক্ষমতা নেই।’
সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাঁচটি ল্যাব হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা সার্ভিস একটু কম পাচ্ছি। যেহেতু ল্যাবটা নতুন, কিছু সংকট আছে। তারা একদিন পরপর রেজাল্ট দিতে পারছে। একশ’র বেশি নমুনা তারা পরীক্ষা করতে পারে না। ইম্পেরিয়াল হাসপাতালও একদিন পর পর নমুনা পরীক্ষার রেজাল্ট দিচ্ছে। শেভরণ ল্যাব পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছে একমাস আগে। তারা এখনও শুরু করতে পারেনি। এ মাসের শেষে শুরু করতে পারবে বলে জানিয়েছে তারা। প্রতিদিন যদি আমরা এক হাজার থেকে ১২০০ নমুনাও পরীক্ষা করতে পারতাম, তাহলে সংকট থাকতো না।’
চট্টগ্রামের জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ডা. মাহফুজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে আরও কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫টি পিসিআর মেশিন দিতে হবে। সঙ্গে প্রয়োজনীয় জনবল দিতে হবে। তাহলে নমুনা জট থাকবে না। আরও অনেক আইসোলেশন সেন্টার করতে হবে। উপসর্গ দেখা গেলেই আইসোলেশন সেন্টারে পাঠাতে হবে। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ হবে। তাহলে বিশৃঙ্খলা থাকবে না। আমরা বারবার বলে আসছি, কিন্তু কে শোনে কার কথা। করোনা প্রতিরোধেও কোনো পরিকল্পনা ছিল না, চিকিৎসায়ও নেই। এখন প্রকৃতির ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।’
এ অবস্থায় আক্রান্ত রোগীর দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষায় নিরুৎসাহিত করছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। তাদের মতে, আক্রান্ত হবার পর ১৪ দিন আইসোলেশনে অথবা চিকিৎসাধীন থাকলে যদি আর কোনো উপসর্গ দেখা না যায়, তাহলে তাকে সুস্থ ধরে নেওয়া যাবে। তার আর নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন নেই।
সিভিল সার্জন বলেন, ‘অনেক সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি নেগেটিভ রেজাল্টের ছাড়পত্র না নিয়ে কর্মস্থলে যোগ দিতে দিচ্ছে না। এটা সঠিক নয়। দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে আমাদের সংকট আরও বাড়ছে। ১৪ দিন পর যদি শরীরে নমুনার উপসর্গ না থাকে, তাহলে তারা তো সুস্থ। দ্বিতীয়বার-তৃতীয়বার পরীক্ষার দরকার নেই।’
নমুনা পরীক্ষা নিয়ে এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে উপসর্গ আছে, এমন অনেকেও নমুনা দেওয়ার ঝামেলা এড়িয়ে চলছেন। কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বর-সর্দি-কাশি নিয়ে অনেক রোগী টেলিমেডিসিন সেবা নিচ্ছেন। কিন্তু পরামর্শ দেওয়ার পরও তারা নমুনা পরীক্ষায় আগ্রহী হচ্ছেন না। শুধুমাত্র শ্বাসকষ্ট থাকলেই নমুনা পরীক্ষা অথবা হাসপাতালে ছুটতে আগ্রহী হচ্ছেন রোগীদের অধিকাংশই।
নগরীর লাভ লেন এলাকার বাসিন্দা একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা রিমঝিম আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে আমার জ্বর ও কাশি শুরু হয়। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছি। নমুনা পরীক্ষা করতে যেতে ইচ্ছা করছে না। নমুনা দিয়ে যদি ১৫-২০ দিনেও রেজাল্ট না পাই, সেই নমুনা দিয়ে লাভ কী!’
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক শরীফ চৌহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নমুনা পরীক্ষার নামে চট্টগ্রামে একধরনের তামাশা চলছে। নমুনা নেওয়া হচ্ছে, পরীক্ষার রেজাল্ট আসতে আসতে অনেকে মারা যাচ্ছেন, অনেকে সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। পত্রিকায় দেখলাম, প্রায় ৩০০ আক্রান্ত রোগীর হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের স্বাস্থ্যখাতের অযোগ্যতা-অধঃপতন আর মানুষের প্রতি অবহেলার চূড়ান্ত নমুনা আমরা দেখছি।’