সরকারি খরচে বেসরকারি ‘প্রতারণা’ জেকেজি হেলথ কেয়ারের
২৪ জুন ২০২০ ১২:৫৫
ঢাকা: বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ারকে সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপনের জন্য। এর জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই সরবরাহ করা হতো সরকারি ভাবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এই সুবিধা নিয়ে বাসায় গিয়ে অবৈধভাবে নমুনা সংগ্রহ করতো, যার কোনো অনুমতি ছিল না। আবার বাসা থেকে সংগ্রহ করা নমুনার ফলাফল দেওয়ার ক্ষেত্রেও মানতো না সরকারি নিয়ম। আর এভাবে প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিতো একটা বিশাল অঙ্কের টাকা।
এর আগে গত ১৬ জুন সারাবাংলা.নেটে ‘করোনা পরীক্ষা নিয়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রতারণার জাল’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদে তাদের নানা রকমের প্রতারণার বিষয়ে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। পরবর্তীতে অনুসন্ধানের আরও আর্থিক দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কাছে।
বিনামূল্যে বিভিন্ন বুথ থেকে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে বাসায় গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করে প্রায় প্রতিদিনই অনৈতিকভাবে টাকা আয় করতো। প্রতিদিন সর্বনিম্ন ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা আয়েরও তথ্যও পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি পায় জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা বা জেকেজি হেলথকেয়ার। নমুনা পরীক্ষায় টেকনোলজিস্ট ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের জন্য তাদের রাজধানীর তিতুমীর কলেজে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জায়গা করে দেওয়া হয়। ১২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জেকেজির প্রস্তুতি দেখতেও যান তিতুমীর কলেজে।
ওই সময় জেকেজি হেলথকেয়ারের স্টাফ প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট উইংয়ের প্রধান সাঈদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশের আটটি বিভাগে মোট ৩২০টি নমুনা সংগ্রহ বুথ স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা। পরে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৪৪টি নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করবে তারা। তবে ১৫ জুন পর্যন্ত তাদের ওয়েবসাইটে সাতটি স্থানে বুথ থাকার কথা উল্লেখ আছে।’
তবে বাস্তবে তাদের তেমন কোনো বুথ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘জেকেজি হেলথকেয়ার করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য যেসব নমুনা সংগ্রহ করে, সেগুলো সরকারি একটি ল্যাবে পরীক্ষা করানো হয়। সরকারি ব্যবস্থাপনার কারণে ল্যাব থেকে কোনো খরচ নেওয়া হয় না। জেকেজির বুথগুলোতে যারা কাজ করেন, তাদের সুরক্ষা সামগ্রীও দেওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকেই। তবে অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, জেকেজি হেলথকেয়ারের কর্মীরা বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করছে, যার জন্য বড় অঙ্কের টাকাও নিচ্ছে। অথচ তাদের বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের কোনো অনুমতিই নেই।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, কেবল টাকা নিয়ে নমুনা পরীক্ষা করানোই নয়, বরং এই নমুনা পরীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ল্যাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বচসা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে থাকা সাতটি বুথ থেকে যে পরিমাণ নমুনা দেওয়ার কথা, তার বেশিই দেওয়া হয়ে থাকে ল্যাবে। প্রথমদিকে এই প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষা করা হতো রাজধানীর একটি ল্যাবে। সেখান থেকে জেকেজি হেলথকেয়ারের বিষয়ে অভিযোগ দেওয়ার পরে আরেকটি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এই ল্যাবে তাদের স্থাপিত বুথ থেকে দৈনিক ২ শ’টি নমুনা পরীক্ষা করানোর জন্য তাদের মৌখিকভাবে বলা হয়। কিন্তু তারা সেই কাজ না করে প্রায় প্রতিদিনই ২ শ’এর অধিক নমুনা পরীক্ষা করাতো। যা সংগ্রহ করতো বিভিন্নভাবে প্রতারণার মাধ্যমে রোগীদের বাসায় গিয়ে। এই ক্ষেত্রে তারা জনপ্রতি নমুনা পরীক্ষার জন্য নিতো ৫ হাজার টাকা করে। অনুসন্ধানে জানা যায় একদিন তারা নমুনা জমা দেয় ৭৯১টি যার মূল্য হিসেবে তারা নিয়েছে ২৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ল্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, যদি দিনে ১০০টা নমুনা বাসা থেকে সংগ্রহ করে ৫০০০ টাকা নিয়ে তবে তার ইনকাম হয় ৫ লাখ টাকা। অথচ তারা কিন্তু সকল প্রকারের সুযোগ সুবিধাই নিয়ে থাকে। এমনকি তাদের নমুনাও পরীক্ষা করানো হয়ে থাকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। বর্তমানে দেশে যখন একদিকে সবাই ব্যস্ত করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার জন্য। সে সময় আসলে এমন দুর্নীতি সরকারকে জিম্মি করে ফেলার মতো হয়ে যায়। যার জন্য জনগণকে এই সব প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরে এ বিষয়ের সত্যতা জানা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আপনাদের অনুসন্ধানের তথ্য ঠিক আছে। তারা আরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করিয়েছে। ১ হাজার নমুনা জমা দেওয়ার অভিযোগও আমরা পেয়েছি। তাদের এ বিষয়ে নিষেধ করার পরেও তারা এই কাজ চালিয়ে যায়।
নমুনা পরীক্ষা করা একাধিক ল্যাব সূত্রে জানা যায়, জেকেজি হেলথকেয়ারের বিষয়ে আমরা একাধিকবার জানিয়েছি স্বাস্থ্য অধিদফতরে কিন্তু সেখান থেকে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলা হলেও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখিনি। সম্প্রতি তাদের নমুনা দেওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমে এসেছে সারাবাংলা.নেটে সংবাদ প্রকাশের পরে। কিন্তু তাও তারা বাসা থেকে সংগ্রহ করা নমুনা জমা দিচ্ছে।
যে ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ করে জমা দিতো সেখানে কথা বলে জানা যায়, জেকেজি হেলথকেয়ারের কোনো নমুনা আমাদের এখানে জমা থাকতো না। কষ্ট হলেও আমরা করে দিতাম। নতুবা তারা দুর্ব্যবহার করতো, প্রধানমন্ত্রী অফিসে নালিশ দিবে বলে ধমক দিতো। আমরা দেশের জন্য কাজ করছি। এখানে আসলে আর অন্য কোনো ধমক বা দুর্ব্যবহার সহ্য করাটাও দুর্ভাগ্যজনক। এ বিষয়ে আমরা একাধিকবার অধিদফতরের মহাপরিচালককেও জানিয়েছি।
এসব বিষয় নিয়ে ল্যাবসহ স্বাস্থ্য অধিদফতরেও একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, জেকেজি হেলথকেয়ারের নমুনা পরীক্ষাসহ তাদের জন্য পিপিই বিতরণের পক্ষে সুপারিশ রয়েছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের।
জেকেজি কোভিড টেস্টিং প্রজেক্ট কর্মকর্তা সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস দিয়েও উত্তর মেলেনি।
তবে এর আগে ১৭ জুন সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কাছে সরাসরি বাসায় থেকে নমুনা সংগ্রহের কথা অস্বীকার করেন। বলেন, ‘আমরা বাসায় গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করাই না।’
এরকম অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে এবং এ প্রতিবেদক নিজেও আগ্রহ জানালে তার সঙ্গেও যোগাযোগ করে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হবে বলে জানানো হয়েছে—এ তথ্য দিলে সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে এ বিষয়ে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।’ নমুনা পরীক্ষার জন্য জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
সাঈদ চৌধুরী জানান, তাদের ৪৪টি বুথে নমুনা সংগ্রহ চলছে। এই প্রতিবেদক সাতটির বেশি বুথ পাননি জানালে তিনি বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক আরও বুথ আছে আমাদের। আমরা দ্রুতই এ বিষয়ে জানাব।’
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির এমডি আরিফুল চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এই প্রতিষ্ঠান থেকে অব্যাহতি নিয়েছি ৪ জুন থেকে। এ বিষয়ে আমি জানিয়েছি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালকদেরকেও। তাই আসলে এমন কোনো বিষয়ে আমি জড়িত না।’
কিন্তু ৪ জুনের পরে তিতুমীর কলেজের কর্মচারীদের সঙ্গে জেকেজির স্টাফদের সংঘর্ষের ঘটনার পরে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী গণমাধ্যম কর্মীদের বক্তব্য দেন।
এ বিষয়ে ডা. সাবরিনা বলেন, ‘আমার কাছে সবাই জানতে চেয়েছিল তাই আমি বক্তব্য দিয়েছিলাম কিন্তু আমি তখন কোনো দায়িত্বে ছিলাম না। পরবর্তীতে আমি গণমাধ্যমে সবাইকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেই।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করানোর বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বাসায় গিয়ে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি যেহেতু তাদের নেই সেটাও তাদের বন্ধ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
দেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি দুই প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় নমুনা সংগ্রহের অনুমতি। তার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান ওভাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা তথা ‘জেকেজি হেলথকেয়ার’। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ নমুনা সংগ্রহের অনুমতি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির এবং সেটি করার কথা বিনামূল্যে। তবে সারাবাংলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে— প্রতিষ্ঠানটি নমুনা সংগ্রহ নিয়ে নানা ধরনের জালিয়াতিতে যুক্ত। জেকেজি হেলকেয়ারের এমন সব অনিয়ম-জালিয়াতি নিয়ে সারাবাংলার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব এটি। চতুর্থ পর্বও থাকছে আসছে আজ বুধবারই (২৪ জুন)।
প্রথম পর্ব: করোনা পরীক্ষা নিয়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রতারণার জাল
দ্বিতীয় পর্ব: অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ধমক দিয়ে কাজ করাত জেকেজি হেলথকেয়ার
সারাবাংলা/এসবি/এমআই