বিদ্যুৎ বিতরণ: ৩ বছরের প্রকল্পে ৪ বছরে অগ্রগতি ৩৪ শতাংশ!
২ জুলাই ২০২০ ০৮:২৭
ঢাকা: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার ৪১টি উপজেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকায় তিন বছর মেয়াদে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। তিন বছর, অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদ শেষে ভৌত অগ্রগতি ছিল মাত্র ২৭ শতাংশ। এরপর আরও দুই বছর মেয়াদ বাড়ালেও বর্ধিত মেয়াদের সাত মাসে অগ্রগতি বেড়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। অর্থাৎ সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৪ শতাংশে!
এদিকে, প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতির চিত্র ভৌত অগ্রগতির চেয়েও খারাপ। সাড়ে তিন বছরে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২৬ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে বর্ধিত দুই বছরের মধ্যেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলেই আশঙ্কা করা হয়েছে প্রকল্পটির মূল্যায়নের খসড়া প্রতিবেদনে। সেক্ষেত্রে প্রকল্পের কিছু অংশ বাদ দিয়ে বাড়তি জনবল নিয়োগ ও কঠোর মনিটরিংয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আরও একবছর মেয়াদ বাড়িয়ে সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনের খসড়া সারাবাংলার হাতে রয়েছে।
জানা যায়, বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী ও উন্নত করার মাধ্যমে জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্য নিয়ে ‘ওয়েস্ট জোন এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও আপগ্রেডেশন প্রকল্প’টি হাতে নেয় সরকার। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ৪১ উপজেলায় বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদ ধরা হয় প্রকল্পটির।
আইএমইডি প্রকল্পটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৬৮৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্পটির মূল মেয়াদ (২০১৯ সালের জুন) শেষে দেখা যায়, ওই সময় পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি ছিল মাত্র ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ কারণে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এসময় ব্যয়ও বেড়েছিল প্রকল্পটি।
প্রকল্প কার্যক্রমে ধীর গতির কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নজনিত সমস্যা। ভূমি অধিগ্রহণে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এছাড়া দরপত্র আহ্বানে সিদ্ধান্তহীনতা, বিতরণ লাইনের রাইট অব ওয়ে সংক্রান্ত জটিলতা এবং জনবলের ঘাটতির মতো বিষয়গুলো প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পথে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।
প্রকল্পে যত জটিলতা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির আওতায় এক হাজার ৭২২টি বিতরণ ট্রান্সফরমার স্থাপন এবং ৪৪৯ দশমিক ২৫ কিলোমিটার ৩৩ কেভি বিতরণ লাইন স্থাপন ও ৬০৫ কিলোমিটার পুর্নবাসন বা নবায়ন ও ৬২ কিলোমিটার ১১ কেভি বিতরণ লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। এছাড়া ৩১টি নতুন ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র স্থাপন ও ৩২টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র পুর্নবাসন বা নবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ ৪১টি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্পটিতে ৬২ জন জনবল থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে সব পর্যায় মিলে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১৯ জন। এটি প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দেরির একটি অন্যতম কারণ। বর্তমানের প্রকল্পটির যে ভৌত অগ্রগতি (৩৪ দশমিক ৫০ শতাংশ), তা প্রকল্পের মেয়াদকালের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মেয়াদের মধ্যে কোনোভাবেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। এছাড়া ৩১টি নতুন উপকেন্দ্রের মধ্যে জিআইএস ও এআইএস মিলিয়ে ছয়টি কেন্দ্রের কাজ বর্তমানে চলছে। এর মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত দু’টি এআইএস উপকেন্দ্র কমিশনিংয়ের মাধ্যমে চালু করা হয়েছে। বাকি ২৫টির মধ্যে ২২টির জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে ২০টি জমি বুঝে পাওয়া গেছে। অন্যগুলোর মধ্যে দু’টির স্থান পরিবর্তনের বিষয়টি অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন।
প্রকল্পের দুর্বল দিক ও ঝুঁকি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির সময়ই পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। ফলে কোনো কাজই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া একজন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকলেও এই প্রকল্পের বাইরে তাকে আরও দায়িত্ব পালন করতে হয়। একই ব্যক্তি একাধিক দায়িত্ব পালন করায় প্রকল্পের কাজে যথাযথ মনোনিবেশ করতে পারেননি। ফলে কাজের অগ্রগতি ব্যহত হয়।
প্রকল্পে ঝুঁকি বিষয়ে বলা হয়েছে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপনের ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা যন্ত্রপাতির ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে যেকোনো মেরামত বা সম্প্রসারণ কাজের সময় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হবে। এ পদ্ধতি চলমান থাকলে ভবিষ্যতে গৃহীত প্রকল্পের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময়ের কারণে অতিরিক্ত ব্যয় লাগতে পারে। তাই এর বিকল্প নিয়ে চিন্তা ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
আইএমডির সুপারিশ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন উপকেন্দ্র নির্মাণে যে দু’টির স্থান পরিবর্তনের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া এখনো শেষ করা যায়নি, সেগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করে ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন ও দরপত্র আহ্বান করতেই আরও প্রায় তিন বছর লেগে যেতে পারে। ফলে চলমান প্রকল্প থেকে ওই দু’টি উপকেন্দ্র বাদ দেওয়া যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে আলাদাভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে এই দু’টি উপকেন্দ্র।
এছাড়া ধীরগতির কারণে প্রকল্পের মেয়াদ একবছর বাড়িয়ে একটি সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে কঠোর মনিটরিং করতে হবে। ঘাটতি পূরণে অবিলম্বে জনবল নিয়োগ করতে হবে এবং বিতরণ উপকেন্দ্রের নির্বাচিত স্থানের সব সুবিধাভোগীদের মতামত নিয়ে স্থান নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডি’র সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, চলমান প্রকল্প পরিবীক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে এর মধ্যে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করা। সেই সঙ্গে সমস্যা সমাধানে কী কী করণীয়, সেসব বিষয়ে সুপারিশ করা। আমরা সেই কাজটি করছি। চলতি মাসেই প্রতিবেদনটির খসড়া চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন এটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওআ হবে। তারা আইএমইডির দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে।