Tuesday 08 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাজেট প্রত্যাখান বিএনপির


২ জুলাই ২০২০ ১৩:১৩ | আপডেট: ২ জুলাই ২০২০ ১৫:৫০
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকা: সংসদে পাস হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটকে অপরিণামদর্শী ও বাস্তবতাবিবর্জিত গতানুগতিক আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখান করেছে রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি।

বৃহস্পতিবার (২ জুলাই) উত্তরার বাসা থেকে জুমমিটিং প্রেস কনফারেন্সে বাজেট প্রত্যাখানের ঘোষণা দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে বুধবার (১ জুলাই) বিএনপির সংসদ সদস্যরাও বাজেট প্রত্যাখান করেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট পাস হয়েছে, সেটি অপরিণামদর্শী ও বাস্তবতাবিবর্জিত গতানুগতিক বাজেট; যাকে অর্থনীতিবিদরা স্বপ্নবিলাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। জনগণের কাছে ন্যূনতম জবাবদিহিতাহীন, আমলাচালিত, ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট সরকারের কাছে এমন বাজেটই প্রত্যাশিত। এই বাজেট আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে সংক্ষিপ্ত করার খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে এবারের বাজেট বরাদ্দ নিয়ে প্রত্যাশিত দীর্ঘ আলোচনা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। মাত্র একদিন (২৩ জুন) বাজেটের সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে, যা অকল্পনীয়। অথচ ভার্চুয়াল অধিবেশন চালিয়ে হলেও বাজেট আলোচনা দীর্ঘায়িত করে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করা যেত। বাজেটের সমালোচনা এড়াতেই তড়িঘড়ি করে বাজেট পাস করেছে সরকার।’

সরকার বাংলাদেশকে একটি লুটেরা আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চলেছে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘লুটপাটকারী, ধনিকশ্রেণি ও আমলাতন্ত্র-নির্ভর অর্থনৈতিক দর্শনের আলোকে প্রস্তুত হয়েছে এবারের বাজেট। অর্থনীতিবিদরা নানারকমভাবে সরকারকে পথ দেখাতে চেষ্টা করেছেন। বিএনপি করোনা সংকট মোকাবিলায় যেমন ৮৭ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ প্রস্তাবনা দিয়েছিল, একইভাবে এবারের বাজেট কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে গত ৯ জুন সুনির্দিষ্ট পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা সমৃদ্ধ তিন বছরের একটি মধ্যমেয়াদী বাজেটের রূপরেখা দিয়েছিল।’

‘কিন্তু সরকার বিএনপির সুপারিশ ও অর্থনীতিবিদদের মতামত উপেক্ষা করে একটি গতানুগতিক অবাস্তব বাজেট পাস করল’— বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব থেকে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অনুদান ব্যতিত ঘাটতি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশ। বাজেটের ৬৬ শতাংশ আসবে রাজস্ব আয় থেকে৷

বাজেটে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া এবং বিএনপির সুপারিশ মূল্যায়ন করা হয়নি মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এবারের বাজেটেও ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে। যেমন- কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হন, এমন সমালোচনা থাকলেও তা তোয়াক্কা করেনি সরকার। খসড়া বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছিল কালো টাকার মালিকেরা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলে ঐ টাকা তিন বছর বাজারে রাখতে হবে। অর্থবিল পাশের দিন এটা কমিয়ে করা হয়েছে এক বছর। এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের টাকা বিদেশে পাচারের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।’

এবারের বাজেট মানুষকে অসৎ হবার প্ররোচনা দেবে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘কোনো প্রশ্ন ছাড়াই ফ্ল্যাট ও এপার্টমেন্ট কেনা, দালান নির্মাণ, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে যে কেউ কালো টাকা সাদা করতে পারবে এবং এ জন্য কোনো জরিমানা গুনতে হবে না। সরকারের অন্যকোনো কর্তৃপক্ষ এই টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না।’

বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর তীব্র সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সরকারের পকেটে যাবে ২৫ টাকা। এ দেশের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষও যে মোবাইল ফোনে কথা বলে তার কর বাড়ানো হলো, কিন্ত শুল্ক কমানো হয়েছে ধনিকশ্রেণির ব্যবহার্য স্বর্ণালংকারের।’

বাজেটে কৃষি ও কৃষক উপেক্ষিত থেকে গেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘করোনায় দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই কৃষি ও কৃষক। শুধু ভাতের সংস্থান করা নয়, সবজি, মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ, মাংস ও ফল— কোনো কিছুরই অভাব বোধ করতে দেয়নি যে খাত, সেই খাতের জন্য বাজেটে কোনো সুখবর নেই। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে দেশের কৃষি খাতের জন্য ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বেশি। আমরা দাবি করেছিলাম কৃষি ও খাদ্য খাতে চলতি অর্থবছরের জিডিপি ও বাজেটের যথাক্রমে ১.৫ এবং ৫.৭৯ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিশ্ববাজারে তেলের দাম তলানিতে চলে গেলেও এবারের বাজেটে তেলের দাম কমানো হয়নি। করোনার কারণে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসা নিশ্চিত হওয়া প্রায় ১৫ লক্ষ কর্মীর ভবিষ্যতের জন্য রাখা হয়েছে অতি তুচ্ছ বরাদ্দ, বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য নেই কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি, করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন খাত নিয়ে দেওয়া হয়নি সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব।’

মেগা প্রকল্পের বরাদ্দের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তথাকথিত মেগা প্রকল্পগুলোতে এবারও বরাদ্দ কমায়নি। মেগা লুটপাটের লোভ করোনার বছরটাতেও জন্য সম্বরণ করতে পারেনি সরকার। করোনার এই ক্রান্তিকালে কল্যাণমুখী সরকার থাকলে অবকাঠামোর প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ কমিয়ে দিত। সেই টাকা করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে জরুরি ক্ষেত্রগুলোতে ব্যয় করতো।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাজেট ঘাটতির ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার সংস্থান করতেও শেষ পর্যন্ত দায়ভার এসে পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। কেননা বাজেটে বিশাল অঙ্কের কালো টাকা, অপ্রদর্শিত অর্থ সম্পদ, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বিশেষ কোনো তৎপরতা নেই। এমতাবস্থায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশ নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমেই বোঝা যায় এই বাজেট স্রেফ একটা সংখ্যানির্ভর মোহাবিষ্ট ধুম্রজাল সৃষ্টিকারী বাজেট।’

তিনি বলেন, ‘বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে গত অর্থবছরের তুলনায় ৩,৫১৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২৯,২৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ জাতি আশা করেছিল বিরাজমান করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। খসড়া বাজেটের পর এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন মহলের জোরালো সুপারিশ সত্তেও সরকার এ বিষয়ে কোনো কর্ণপাত করেনি। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ আগের মতই থেকে গেছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘করোনার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় ৭৮.৩ শতাংশ পরিবারের উপার্জন কমেছে। অথচ সে বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষার যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। দিন এনে দিন খায় শ্রেণির হতদরিদ্র মানুষের কাছে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়ার যে গণদাবী উত্থাপিত হয়েছে সে বিষয়ে বাজেটে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ইনফরমাল খাতটি জনসংখ্যার বিরাট অংশ জুড়ে। শুধু ঢাকা শহরেই হকার ও ফেরিওয়ালার সংখ্যা তিন লাখের বেশি। দরজি কয়েক লাখ। রিকশাচালক প্রায় ১০ লাখ। লবণশিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ শ্রমিক। এক লাখের বেশি জেলে ও শ্রমিক জড়িয়ে আছেন শুঁটকি শিল্পের সঙ্গে। সারাদেশে পরিবহনশ্রমিকের সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ লাখ। ঢাকা শহরে ‘ঠিকা বুয়া’র সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখের বেশি। কোভিড–১৯ এর ফলে এই শ্রমজীবী মানুষের প্রায় সবাই বেকার। বাজেটে তাদের নূন্যতম চাহিদা মেটানোর বিশেষ বরাদ্দ নাই।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই বাজেট করোনার সময় স্বাস্থ্য সংকটে পড়া মানুষের নাভিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেওয়ার বাজেট, এই বাজেট করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া কোটি কোটি অনাহারী মানুষকে দুর্ভিক্ষের মধ্যে ঠেলে দেয়ার বাজেট, এই বাজেট কৃষিকে ধ্বংস করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলার বাজেট, এই বাজেট দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার না করে আরও গভীর মন্দায় ফেলে দেয়ার বাজেট, এই বাজেট দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে ফেলার বাজেট, এই বাজেট দেশের কর্মক্ষম বেকার মানুষকে বেকার রেখে দেওয়ার বাজেট, এই বাজেট গরীব মানুষের সুবিধা কমিয়ে ধনীদের সুবিধা বাড়িয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধির বাজেট, সর্বোপরি এই বাজেট রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটকারীদের আরও সুযোগ বৃদ্ধির বাজেট।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, এসএমই, গ্রামীণ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবন-জীবিকা রক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম ব্যয় বরাদ্দের ফলে এদেশের জনগণের মাঝে সীমাহীন হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এই বাজেট আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।’

২০২০-২১ অর্থবছর প্রত্যাখান বাজেট বিএনপি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর