Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিগারেটের বাড়তি করের অর্থ যাচ্ছে ডিলার ও মজুতদারের পকেটে!


১৬ জুলাই ২০২০ ১১:১০

ঢাকা: প্রতিবছরের মতো ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও তামাকজাত পণ্যের মধ্যে বেশকিছু সিগারেটে শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। বেড়ে যাওয়া সিগারেটের নতুন মূল্যও নির্ধারণ করে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে বাজারে এখনো আগের উৎপাদিত সিগারেটই বিক্রি হচ্ছে। তবে দাম নেওয়া হচ্ছে বাড়তি, নতুন বাজেট অনুযায়ী। ফলে ধূমপায়ীদের পকেট থেকেও বাড়তি করের টাকা বের হচ্ছে। তবে বাড়তি এই করের টাকা জমা হচ্ছে না রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। অবৈধভাবে এই বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু মজুতদার ও মাঠ পর্যায়ে সিগারেট বিপণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটর)।

বিজ্ঞাপন

শুধু তাই নয়, কিছু ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি পুরোনো সিগারেটই নতুন দামে সরবরাহ করলেও ক্যাশ মোমো দিচ্ছে পেছনে ফেলে আসা সেই ২০১৬ সালের! অবৈধভাবে সিগারেট মজুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আইনের ফাঁকফোঁকরের আশ্রয় নিয়ে বাজেটকে কেবলই তাদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলোও অবৈধ এই বিষয়টিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

প্রায় প্রতিবছরই বাজেটে তামাকপণ্যে শুল্ক ও কর বাড়ানো হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এবারের বাজেট অনুযায়ী সিগারেটের নিম্ন স্তরের ১০ শলাকার দাম ৩৯ টাকা ও তার বেশি এবং সম্পূরক শুল্ক ৫৭ শতাংশ। মধ্যম স্তরের ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৬৩ টাকা বা তার বেশি, উচ্চ স্তরের ১০ শলাকার দাম ৯৭ টাকা বা তার বেশি এবং অতি-উচ্চ স্তরের ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ১২৮ টাকা বা তার বেশি। তিনটি ক্যাটাগরিতেই সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ।

কেবল সিগারেট নয়, বিড়িতেও বেড়েছে শুল্ক। যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া হাতে তৈরি ফিল্টারবিহীন বিড়ির ২৫ শলাকার দাম ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা, ১২ শলাকার দাম ৬ টাকা ৭২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ও ৮ শলাকার দাম ৪ টাকা ৪৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিড়ির জন্য সম্পূরক শুল্ক আগের মতোই ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া ফিল্টার সংযুক্ত বিড়ির দাম ৮ টাকা ৫০ পয়সা টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক আগের মতো ৪০ শতাংশ অব্যাহত রাখা হয়েছে বাজেটে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে এখনো আগের উৎপাদিত সিগারেটই বিক্রি হচ্ছে। অথচ দাম নেওয়া হচ্ছে নতুন বাজেট অনুযায়ী। কয়েকজন ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বললে তারাও এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান।

তেজগাঁওয়ের শাহীনবাগের দোকানী পনু সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিগারেট কোম্পানিগুলো নতুন দাম নিচ্ছে। কিন্তু পুরোনো রেটের বা পুরাতন সিগারেট দিচ্ছে। তবে দুয়েকটি ব্র্যান্ডের নতুন সিগারেটও বাজারে এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘বাজেটের আগে বেনসন ২৪৬ টাকায় কিনে বিক্রি করেছি ২৬০ টাকায়। এখন ২৫৭ টাকায় কেনা পড়ছে। বিক্রি করছি ২৮০ টাকায়। মার্লবোবোর ক্ষেত্রে একই অবস্থা। গোল্ডলিফ ও স্টারের দাম বাড়েনি। আগের মতো গোল্ডলিফ ১৮৬ টাকায় কিনে ২০০ টাকায় বিক্রি করছি। আর স্টার ১২৬ টাকায় কিনে ১৪০ টাকায় বিক্রি করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কমদামের মধ্যে হলিউড, ডার্বি, পাইলট ও শেখের দাম বেড়েছে। সিগারেটগুলো আগে ৭৪ টাকায় কেনা পড়ত, এখন ৭৮ টাকায় কেনা পড়ছে। আর বিক্রি ১০০ টাকা-ই। তবে হলিউড বাদে অন্যগুলো পুরাতন রেটের সিগারেটই দিচ্ছে। আর বিড়ি আগে ১৬ টাকায় কিনে ১৮ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন ১৮ টাকায় কিনে ২০ টাকায় বিক্রি করছি।’

মহাখালীর আড়জতপাড়ার একটি দোকানের মালিক পিয়াস সারাবাংলাকে বলেন, ‘নতুন রেটের সিগারেট বাজারে কম। আগের রেটের সিগারেটই কোম্পানিগুলো নতুন রেটে বিক্রি করছি। কিছু কিছু সিগারেট আমাদের গায়ের রেটের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।’ মহাখালীর বউবাজারের একটি স্টোরের মালিক রুপনও সারাবাংলাকে বলেন, সব সিগারেটই নতুন রেটে রাখতে হচ্ছে। অথচ সিগারেটের গায়ে পুরনো রেট।

মিরপুরের একটি স্টোরের মালিক রফিক বলেন, আমরা কোম্পানির গাড়ি থেকে সিগারেট রাখি। বাজেটের পর থেকেই তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সিগারেটের গায়ে আগের দামই লেখা আছে। তারা আসলে ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। হয়তো তারা আগের সিগারেট মজুত করে রেখে এখন বাড়তি লাভের আশায় নতুন দামে বিক্রি করছে।

জানতে চাইলে সোহেল নামের এক ধূমপায়ী বলেন, বেনসনের প্যাকেটে ২৪৬ টাকা লেখা আছে। আগে ২৬০ টাকায় কিনতে পারলেও এখন ২৭০ টাকার কমে কেনা যাচ্ছে না। প্রতিবছরই বাজেটের পর এমন হয়। আর ছোট দোকান থেকে একটি বেনসন কিনতে গেলে ১৫ টাকা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। অথচ সরকার এখনো এর রাজস্ব পাচ্ছে না। তাহলে বাড়তি কর দিচ্ছি কেন? আমরা সরকারকে কর দিচ্ছি, তা যেন কারো অবৈধ ব্যবসার হাতিয়ার না হয়। আর এমনিতেই সিগারেট কোম্পানিগুলো আমাদের শুষে নিচ্ছে। বিপণন পর্যায়ে যেন কোম্পানিগুলো আরও তদারকি বাড়ায়।

ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলো পুরনো তারিখে পুরনো সিগারেট বিক্রি করছে। অথচ দাম নিচ্ছে নতুন বাজেট অনুযায়ী। এমনই একটি কোম্পানি দ্য জামাল অ্যান্ড কোং। মহাখালী এলাকায় এই কোম্পানিটি সিগারেট সরবরাহ করে থাকে। সম্প্রতি বেশ কিছু দোকানে দেওয়া তাদের মেমোতে ২০১৬ সালের তারিখ দেখা গেছে। এতে করসহ বাড়তি টাকা নেওয়া হলেও তার হিসাব না থাকায় বড় ধরনের ফাঁকি দেওয়া সহজ হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা এ অভিযোগ অস্বীকার করছেন।

জানতে চাইলে জামাল অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার মো. ফরহাদ সারাবাংলাকে বলেন, কোনো কারণে মেশিনের ভুলের কারণে এটি ঘটতে পারে। সফটওয়্যারের সমস্যার কারণেও হতে পারে। অথবা যারা মেশিন অপারেট করেছেন, তাদের কারণে এমনটি হতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে কর বা ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার সম্পর্ক নেই। আমরা যখন ওয়্যারহাউজ থেকে সিগারেট বের করি, তখনই ভ্যাট পরিশোধ করা হয়।

তিনি আরও বলেন, সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে পুরোনো মূল্য থাকলেও আমাদেরকে নতুন দাম দিয়ে কোম্পানি থেকে সিগারেট নিতে হয়। আর কোম্পানিগুলো নতুন রেটেই ভ্যাট পরিশোধ করে। শুধুমাত্র এখানে পুরোনো প্যাকেট ব্যবহার হচ্ছে।

ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলো নিজেরাই মজুত করে পুরোনো সিগারেট এখন নতুন দামে বিক্রি করছে— এমন অভিযোগের বিষয়ে জনতে চাইলে জামাল অ্যান্ড কোং এর এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের পক্ষে মজুত করা সম্ভব নয়। আমরা প্রতিদিনের সিগারেট কোম্পানি থেকে এনে থাকি।

তবে তামাক কোম্পানির কর্মকর্তারা ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ডিলাররা বাজেটের আগেই দুই-তিন মাস ধরে সিগারেট মজুত করতে থাকে। মার্চ, এপ্রিল থেকে বাজেট পাস হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকে। আমরা যখন সিগারেট উৎপাদন করি, আমাদের এখানে মজুত সম্পূর্ণ অবৈধ। সিগারেট উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেটজাত করার সময়ই সরকারের শুল্ক কর পরিশোধের স্টিকার সিগারেটের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়।

এর অর্থ, বাজারে যেসব সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে পুরনো দাম লেখা থাকলেও নতুন করহার অনুযায়ী দাম রাখা হচ্ছে, সেগুলো মূলত মজুত করা সিগারেট। আর ডিলারদের এই মজুতে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও থাকে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর ওই কর্মকর্তা বলেন, আইন অনুযায়ী উৎপাদন পর্যায়ে একদিনের সিগারেট একদিনেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। সেটাই হয় সাধারণত। তবে মার্চ, এপ্রিলে ডিলাররা অনেক বেশি সিগারেট নিয়ে থাকে। বাজেটের আগে ডিলাররা যে সিগারেট মজুত করে, কোম্পানিগুলো তা জানলেও টার্গেট পূরণে এই সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে।

মন্তব্য জানতে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর সিগারেটের গায়ে উল্লেখ থাকা ইনকোয়ারি নম্বরে কল করা হলে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। ওয়েবসাইটে দেওয়া হটলাইন নম্বরে কল করেও উত্তর পাওয়া যায়নি। আর জাপান টোবাকো বাংলাদেশকে গত সোমবার (১৩ জুলাই) মেইল করেও এখন পর্যন্ত ফিরতি মেইল পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট নীতির এক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, আমরা সিগারেটের উৎপাদন পর্যায়ে কর বা ভ্যাট আরোপ করে থাকি। সিগারেটের উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে শুল্ক কর পরিশোধের স্টিকার বা স্ট্যাম্প লাগানো হয়। ওই স্টিকার লাগানো অর্থই রাজস্ব পরিশোধিত। অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং বাজারে এখন পুরোনো যে সিগারেটগুলো বিক্রি হচ্ছে, ডিলার কিংবা দোকানদার যারা বিক্রি করছেন, তারা মূলত আগের মজুত করা সিগারেট নতুন দামে বিক্রি করছেন।

তামাকবিরোধী একটি সংগঠনও বলছে, বাজেটেকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই অবৈধভাবে সিগারেট মজুত করা হয়। জুলাইয়ের প্রায় পুরো মাসই আগে উৎপাদিত সিগারেট বাজারে বিক্রি হয়ে থাকে। এই কালোবাজারির মাধ্যমেই ধূমপায়ীদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়, অথচ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র। জানতে চাইলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।

তামাক পণ্য শুল্ক সিগারেট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর