Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সঙ্গীত ভবনে হামলা-ভাঙচুর, প্রতিবাদে সোচ্চার সংস্কৃতিকর্মীরা


১৭ জুলাই ২০২০ ২১:৫৩

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর প্রবর্তক সংঘ পাহাড়ে অর্ধশত বছরের পুরনো একটি সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এসময় সঙ্গীত শিক্ষার বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর ও তছনছ করা হয়। এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, অনাথ আশ্রম প্রবর্তক সংঘে বসবাসরত একদল স্কুলছাত্র এই ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রবর্তক সংঘ কমিটির সঙ্গে ভাড়াটিয়া প্রতিষ্ঠান ‘সঙ্গীত ভবনের’ বিরোধের জেরে তাদের ইন্ধনে এই হামলা হয়েছে। তবে প্রবর্তক সংঘ কমিটি হামলায় তাদের ইন্ধনের অভিযোগ অস্বীকার করে সঙ্গীত ভবন পরিচালনায় যুক্তদের একগুঁয়েমি মনোভাবের অভিযোগ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (১৭ জুলাই) সকাল ১১টার দিকে নগরীর পাঁচলাইশ থানার সুগন্ধা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে এই হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রামে সঙ্গীত শিক্ষার প্রসারে খ্যাতিমান সঙ্গীতগুরু প্রিয়দারঞ্জন সেনগুপ্ত ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠান করেন ‘সঙ্গীত ভবন’। প্রবর্তক সংঘ থেকে জমি ভাড়া নিয়ে ১৯৬৮ সালে তিনি গড়ে তোলেন স্থায়ী সঙ্গীত শিক্ষার স্কুল ও আবাসিক একতলা ভবন। তার মৃত্যুর পর ছেলে দীপক সেনগুপ্ত এর কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছিলেন। দীপক সেনের মৃত্যুর পর তার বোন কাবেরী সেনগুপ্ত সেখানে বসবাস করে সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।


দীপক সেনগুপ্তের মেয়ে তিষণ সেনগুপ্ত সারাবাংলাকে জানান, ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন প্রবর্তক সংঘ পরিচালনা কমিটির সঙ্গে সঙ্গীত ভবনের বিরোধ চলছে। একতলা ভবনটি দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি তারা সেটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। শুক্রবার শ্রমিকরা কাজ করতে এলে পুলিশ এসে তাদের বাধা দেয়। বিকেল চারটায় থানায় এ নিয়ে বৈঠকের কথা বলে পুলিশ ফিরে যায়। শ্রমিকরাও কাজ বন্ধ করে দেয়।

বিজ্ঞাপন

‘আমরা বাসার ভেতরে ছিলাম। সকাল ১১টার দিকে দেখি হঠাৎ করে হুড়মুড় করে ৩০-৪০ জন শিশু-কিশোর আমাদের বাসার সামনে আসে। তারা দেশীয় বিভিন্ন ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রথমে সঙ্গীত ভবনের বাঁশের সীমানা উপড়ে ফেলে। ভবনের দেওয়ালে আঘাত শুরু করে। একপর্যায়ে তারা ভেতরে ঢুকে হারমোনিয়াম-তবলা, তানপুরাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর ও লুটপাট করে। আমরা দ্রুত বেরিয়ে আসি। খবর পেয়ে সঙ্গীত ভবনের শিক্ষার্থীরা আসেন। তখন ভাঙচুরকারীরা চলে যায়। প্রবর্তক সংঘের কমিটির ইন্ধনে আশ্রমের বাসিন্দা শিশু-কিশোররা এই ঘটনা ঘটিয়েছে’, বলেন তিষণ সেনগুপ্ত

সঙ্গীত ভবন পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নূরনবী মিরণ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত আদালতে ভাড়া পরিশোধ করি। আমরা কোনো বিরোধে নেই। এরপরও প্রবর্তক সংঘের কোনো আপত্তি থাকলে, আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারত। সেটা না করে তারা সন্ত্রাসী কায়দায় একটি ৫২ বছরের পুরনো সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর এভাবে হামলা করবে, এটা ভাবা যায় না। স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের তারা ব্যবহার করে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।’

প্রবর্তক সংঘ পরিচালনা কমিটির সম্পাদক তিনকড়ি চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রিয়দারঞ্জন চক্রবর্তী প্রবর্তক সংঘের কাছ থেকে জমি ভাড়া নিয়ে সঙ্গীত ভবন গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরও তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন কোনো সমস্যা হয়নি। উনার মৃত্যুর পর ছেলে দীপক সেনগুপ্তের নামে আমরা ভাড়ার রসিদ দিয়েছি। ৬-৭ বছর আগে আমরা শুনি, দীপক বাবু পরিবার নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন এবং সেখানে তিনি মারা গেছেন। এরপর আমরা তাদের উত্তরাধিকারের খোঁজ করি। তখন কাবেরী সেনগুপ্ত জানান, তিনি অধ্যক্ষ। আমরা তাকে নতুনভাবে আমাদের সঙ্গে ভাড়ার চুক্তি করার কথা বলি কিন্তু তিনি মানতে রাজি নন। উনি আদালতে চলে গেলেন। আমরাও আর কোনো কথা বলিনি।’

‘গত সপ্তাহে দেখি তারা ৬-৭টা দরজা-জানালা খুলে ফেলেছে। নতুন করে কাজও শুরু করে দিয়েছে। তখন আমরা গিয়ে বললাম, আপনারা তো মালিককে না জানিয়ে এভাবে কাজ করতে পারেন না। তারা বললেন, মালিক আদালত। আমরা বললাম, আদালতের অনুমতি নিয়েছেন? তাদের কাছে আদালতের কোনো অনুমতি নেই। তখন আমরা পুলিশকে জানাই। আজ (শুক্রবার) আবারও কাজ শুরুর পর পুলিশ এসে কাজ বন্ধ করে দেয়। পুলিশ চলে যাবার পর তারা আবারও কাজ শুরু করে। তখন আমাদের ছোট ছোট কয়েকজন ছেলে এইট-নাইনের ছাত্র তারা, মাথা গরম করে বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি সীমানা তুলে এনেছে। ঘরে ঢুকে ভাঙচুরের ঘটনা সাজানো।’

তিনকড়ির দাবি, দীপক সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর তাদের প্রকৃত উত্তরাধিকার নিয়েও সমস্যা আছে। সেই সমস্যা সমাধানের কথা বললেও সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ সেটা মানছেন না।

তিষণ সেনগুপ্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমি উত্তরাধিকার হিসেবে আছি। আমার কাকা-পিসিরা এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আছেন। এছাড়া কমিটিও আছে। উত্তরাধিকারের কথা বলে তারা ঐতিহ্যবাহী একটি সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তুলে দিতে চায়।’


সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ কাবেরী সেনগুপ্তা বলেন, ‘ভবনটি একেবারে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ছাদ থেকে পানি পড়ে। বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পানিতে আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে। সেজন্য আমরা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সঙ্গীত ভবন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছে। দেশের অনেক প্রথিতযশা শিল্পী এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী। একটি অপশক্তি এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে চায়। আমি সবাইকে এই প্রতিষ্ঠান রক্ষায় এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি।’

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার বিজয় কুমার বসাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আমরা পরিদর্শনে গিয়ে এর সত্যতা পেয়েছি। উভয়পক্ষকে সমঝোতায় আসতে বলেছি। আমরা মধ্যস্থতা করব। তারা যদি সমঝোতায় আসতে না পারে, তাহলে ভাঙচুরের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’

এদিকে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মীরা সঙ্গীত ভবনে ‘হামলার’ নিন্দা ও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সঙ্গীত ভবনের ওপর হামলা শিল্পী সমাজের জন্য লজ্জার। ভূমিদস্যুরা সঙ্গীত ভবনের ওপর হামলা করেছে। আমরা মন্ত্রী, মেয়র, সাংসদ, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এর বিচার দাবি করছি।’


উদীচী চট্টগ্রামের সংগঠক অধ্যাপিকা শীলা দাশগুপ্তা লিখেছেন, ‘তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। একটি সুপ্রতিষ্ঠিত, সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপর হামলা মেনে নেওয়া যায় না। আমি মাননীয় মেয়র, মন্ত্রী ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। প্রবর্তকের মতোন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা কিভাবে এ জঘন্য কাজ করতে পারে? তারা কি গুন্ডা তৈরী করে? এ লজ্জা রাখবো কোথায়।’

সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগের যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম ইউসুফ সোহেল লিখেছেন, ‘প্রবর্তক সংঘ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে ক্রমাগতভাবে ধর্মীয় লেবাস লাগিয়ে এর ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা হচ্ছে। তারা চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পীঠস্থান সঙ্গীত ভবনের ওপর হাত দিয়েছে। আমরা এর নিন্দা জানাচ্ছি ও বিচার দাবি করছি।’

নব্বই দশকে প্রবর্তক সংঘ পরিচালনায় যুক্ত মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি উভয়পক্ষের কাছে সর্বোচ্চ ধৈর্য্য প্রত্যাশা করছি। উভয় প্রতিষ্ঠানই দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে বিরোধ হতে পারে। সেটা সমাধানের জন্য আলোচনার পথ খোলা রাখা উচিৎ। কোনোভাবেই হামলা-ভাঙচুরের পথে যাওয়া সমাধান হতে পারে না।’

চট্টগ্রাম টপ নিউজ প্রবর্তক সংঘ ভাঙচুর সঙ্গীত সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হামলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর