করোনায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ধীর গতি
১৯ জুলাই ২০২০ ১০:২০
ঢাকা: করোনাকালীন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ১৯টি প্যাকেজের আওতায় এক লাখ কোটি টাকারও বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু এর পর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ১১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতের জন্য ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র ২০৬ কোটি টাকা। বাকি প্যাকেজগুলোর অবস্থা প্রায় একই রকম। আবার কোনো কোনো প্যাকেজের ঋণ বিতরণ এখনও শুরুই হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ দ্রুত ছাড়া দেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক ব্যাংকগুলোকে মনিটরিং করছে। ইতোমধ্যে শিল্প ও সেবা খাতের ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ১১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ৭৪৩টি প্রতিষ্ঠানের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও এসএমই খাতের খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে ২০৬ কোটি টাকা ১ হাজার ৭৭৫ জনের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।‘
এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তারা বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় গিয়ে প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা নিয়ম-নীতির দোহাই দিয়ে গ্রাহকদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। অনেক শাখায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত প্যাকেজের নীতিমালার কপিই পৌঁছেনি। আবার কোনো কোনো ব্যাংকের শাখা প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণের ব্যাপারে কিছুই জানে না। ফলে ব্যাংকের শাখাগুলো প্রণোদনার আওতায় ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করছে।
জাতীয় ক্ষুদ্র কুটির শিল্প সমিতির সভাপতি মির্জা নূরুল গনি শোভন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও ব্যাংকগুলো প্রণোদনার অর্থ ছাড় না দেওয়ায় ক্ষুদ্র উদ্যেক্তারা কোনো ঋণ পাচ্ছেন না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার নির্দেশ দিলেও ব্যাংকের শাখাগুলো তাতে সাড়া দিচ্ছে না। ব্যাংকের শাখাগুলোর অসহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে তিন মাসে মাত্র ২০০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।’
সূত্র জানায়, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে সরকার মোট ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যার অধিকাংশই ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের ৮টি প্যাকেজের আওতায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হবে। এর মধ্যে রফতানি উন্নয়ন তহবিলের আকার ১২ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। বাকি ৬টি প্যাকেজের আওতায় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করবে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে পুনঃঅর্থায়ন হিসেবে ৩৩ হাজার কোটি টাকা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর সরকার দেবে ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু বেতন প্যাকেজের ঋণ বরাদ্দের তুলনায় বেশি বিতরণ হয়েছে।
এদিকে প্রণোদনা সুবিধা দিতে ব্যাংকগুলো যাতে তারল্য সংকটে না পড়ে সে জন্য ৫১ হাজার কোটি টাকার তহবিল দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে দুই দফায় সিআরআর দেড় শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এতে করে ব্যাংকগুলোর ১৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা বেড়েছে। এপ্রিল ও মে মাসের স্থগিত সুদের ভর্তুকি হিসাবে দিচ্ছে ২ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, করোনায় সবার আগে রফতানিমুখী শিল্পের ৫০ লাখ শ্রমিকের বেতন বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। এককালীন ২ শতাংশ সার্ভিস দিয়ে বিনা সুদে এই ঋণ নিচ্ছেন রফতানিকাররকরা। গত এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন দিতে গঠিত এই তহবিল থেকে দুই মাসেই ফুরিয়েছে ৪ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। ১ হাজার ৯৯২টি প্রতিষ্ঠান ৪৭টি ব্যাংকের মাধ্যমে এপ্রিলে ২ হাজার ৭২৬ কোটি এবং মে মাসে ২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। জুন মাসের বেতন দিতে সরকারের কাছে অর্থ চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সরকার থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
সূত্র আরও জানায়, বড় শিল্প সেবা খাতের জন্য গঠিত ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে বেতন প্যাকেজে আড়াই হাজার কোটি দেওয়া হচ্ছে। আবার এই প্যাকেজ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। করোনার প্রণোদনা ঋণের সবচেয়ে বড় ৩০ হাজার কোটি টাকা প্যাকেজে থেকে অন্য দুটি খাতে ঋণ দেওয়ায় এই প্যাকেজের আকার দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। উদ্যোক্তারা সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন আর বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ ভর্তুকি হিসেবে সরকার পরিশোধ করবে।
করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই খাত। এই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য গঠিত ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ৪ শতাংশ সুদে চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ পাবেন উদ্যোক্তারা। এই তহবিলের অর্ধেক অর্থের যোগান দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ১৫ জুলাই পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র ২০৬ কোটি টাকা। সিএমএসএমই খাতে প্রণোদনার ঋণের সহযোগিতা চেয়ে ইতোমধ্যে তিন শতাধিক উদ্যোক্তা ঢাকা চেম্বারে আবেদন করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই প্যাকেজ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো অর্থ ছাড় করছে না। নানা অজুহাত দেখিয়ে শুধু কাগজপত্র চাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বড় উদ্যোক্তাদের কিছু অর্থ ছাড় দিলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থ দিচ্ছে না। অর্থ না ছাড়লে তো প্রণোদনা কোন কাজে আসবে না। অর্থনীতির ১২টা বেজে যাবে।’
এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকে গিয়েও অনেক ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা প্রণোদনার আওতায় ঘোষিত তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংকের অনেক শাখা আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির দোহাই দিয়ে গ্রাহকদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি চিঠিতে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।’
প্রণোদনার অর্থ দ্রুত ছাড় দেওয়ার জন্য তারা শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছেন বলেও জানান তিনি।