সেরা আইনজীবীরাই কেন ‘বিতর্কিত’দের পক্ষে— আদালতের ক্ষোভ
২০ জুলাই ২০২০ ২৩:৩১
ঢাকা: ভার্চুয়াল কোর্টের সুযোগ নিয়ে থাইল্যান্ড থেকে আগাম জামিনের আবেদন করে উল্টো জরিমানা গুনতে হয়েছে সিকদার গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদারকে। বেআইনিভাবে জামিন চেয়ে ‘আদালতের সময় নষ্ট’ করায় তাদের ১০ হাজার পিপিই জরিমানা করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের পক্ষে এমন আবেদন নিয়ে হাজির হওয়ায় আদালত আইনজীবীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
আদালত বলছেন, একজন বিত্তবান ব্যক্তি কতটা শক্তিশালী হতে পারে, সেটি দেখানোর জন্য মামলাটি শুনানির জন্য রেখেছিলেন। আদালত যে বিত্তশালীদের পক্ষে বিশেষ সুবিধা দেয় না— সেটি জনসাধারণকে বোঝাতেও মামলাটি শুনানির জন্য রাখা হয়েছিল। বিচার বিভাগ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে মানুষের মাঝে— এ অবস্থায় বিচারক, আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষসহ সবাইকে আদালতের অংশ হিসেবে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান আদালত।
আরও পড়ুন- আদালতের সময় নষ্ট করায় ২ সিকদার ভাইকে ১০ হাজার পিপিই জরিমানা
দেশের বাইরে থেকেই হাইকোর্টে দুই সিকদার ভাইয়ের আগাম জামিন আবেদনের শুনানিতে আদালত এসব কথা বলেন। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চে সোমবার (২০ জুলাই) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ওই আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
লন্ডন থেকে আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি। এছাড়া দেশে থেকেই ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন আব্দুল বাসেত মজুমদার, এ এম আমিন উদ্দিনসহ বেশ কয়েজন আইনজীবী। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজেই ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষে। এছাড়া শুনানির সময় সাংবাদিকসহ শতাধিক আইনজীবী অনলাইনে যুক্ত ছিলেন।
এ মামলার শুনানির শুরুতে আদালত আবেদনকারীর পক্ষের আইনজীবীদের কাছে জানতে চান, বিদেশে বসে আগাম জামিনের আবেদনের সুযোগ আছে কি না এবং এ অবস্থায় তাদেরকে জামিনে দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের আছে কি না।
আবেদনের পক্ষের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, এটা ভার্চুয়াল কোর্ট হলেও নিয়মিত আদালতের মতো। কেননা শুনানিতে অনেক আইনজীবী যুক্ত রয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত আছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। মনে হচ্ছে রিয়েল কোর্ট, শুধু শুনানি হচ্ছে ভার্চুয়ালি।
আরও পড়ুন- বিদেশে বসে হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন রন ও দিপু সিকদারের
এ সময় অ্যাটির্নি জেনারেল বলেন, সাংবাদিকেরাও সংযুক্ত আছেন। তখন আদালত বলেন, এই মুহূর্তে ৮১ জন শুনানিতে সংযুক্ত আছেন। সাংবাদিকেরাও আছেন। তারা শুনবেন এবং সঠিক রিপোর্ট করবেন।
আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি এসময় ভার্চুয়াল আদালতের ৪ ধারা উল্লেখ করে বলেন, এ আইন অনুযায়ী যে যেখানেই থাকুক, ভার্চুয়ালি সংযুক্তির মাধ্যমে আদালতে উপস্থিত বলে গণ্য হবে। এই যেমন আমি বিদেশে বসে শুনানি করছি। সুতরাং এটা বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর যেকোনো দেশে থেকেই যে কেউ করতে পারেন।
তিনি বলেন, আমার ক্লায়েন্টরা সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি নিয়ে বিদেশে গেছেন। সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি না পেলে তো তারা যেতে পারতেন না। এখন তারা দেশে চলে আসতে চান। কিন্তু তারা যাওয়ার দুই দিন পর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ পেয়েছে। এয়ারপোর্ট ও তাদের বাসার সামনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। গ্রেফতার এড়িয়ে বাসায় ফিরতে মূলত তারা এ আবেদন করেছেন।
এসময় আদালত বলেন, আপনারা ক্রিমিনাল কোর্টে কেন আবেদন করেছেন? আপনারা হয়রানি ও গ্রেফতার না করার নির্দেশনা চেয়ে সাংবিধানিক কোর্টে যাবেন। তখন আইনজীবী বলেন, দেশে এলে তারা কোথায় কিভাবে আত্মসমর্পণ করবেন, সে বিষয়ে আপনারা শর্ত দিয়ে দিতে পারেন। ভার্চুয়াল কোর্ট আইনে ৪ ধারায় বিচার পদ্ধতিগত বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তারা জামিন চাইছেন। আর এই পদ্ধতিতে যেকোনো জায়গায়, যেকোনো অবস্থা থেকেই অংশ নেওয়া যায়।
এ সময় আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদার। তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন সিনিয়র আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিনও।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শুরুর দিকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আত্মসমর্পণের সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন আছে। কাজেই তারা নিচের কোর্টে (বিচারিক আদালত) গিয়ে উপস্থিত (আত্মসমর্পণ করে) হয়ে জামিন চাইতে পারেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, কোর্টের মহত্ব ও ভাবমূর্তি যেন কোনভাবেই ক্ষুন্ন না হয়, আমাকে সবসময় সেভাবেই শুনানি করতে হয়। আজ এতগুলো আইনজীবী আগাম জামিনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু তারা পারলেন না। কিন্তু একজন অত্যাধিক বিত্তশালী, ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, তিনি যদি এই কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে যান, তাহলে সমাজে কী সিগন্যাল যাবে? এ জন্যই কিন্তু কোর্টের সঙ্গে আজ সাংবাদিকরাও যুক্ত হয়েছেন।
এ সময় আদালত বলেন, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে মামলাটি শুনানির জন্য অন্তর্ভুক্ত করেছি। এ মামলার মধ্য দিয়ে আইনজীবীরা দেখুক, একজন অর্থশালী ব্যক্তি কত শক্তিশালী হতে পারে। তারা (আসামিরা) বাংলাদেশের সেরা সেরা আইনজীবীদের নিজেদের পক্ষে দাঁড় করাতে পারেন। সাংবাদিকরাও দেখুক। আজ সংবাদপত্রে কী লেখা হচ্ছে? সাধারণ মানুষ কী সিগন্যাল পাচ্ছে? সাধারণ মানুষ পত্রিকা পড়ে জানবে, আগাম জামিন দেশে বসেই হয় না, কিন্তু বিদেশ থেকে বসে তাদের আবেদন আদালত শুনতে পারে! সাধারণ মানুষদের এমন প্রশ্নের জবাব তো আমাদেরই দিতে হবে। কারণ, আমাদের প্রতিটি আইনজীবীসহ সবার দায়িত্ব আদালতের সম্মান, ভাবমূর্তি রক্ষা করা। এটা শুধু আদালতের একার দায়িত্ব না। আইনজীবী, বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল মিলেই আদালত। তাই সবাই মিলেই যদি জনগণকে দেখাতে পারি যে এখান থেকে এমন কিছু হচ্ছে না যে এর মাধ্যমে বিত্তশালীরা বিশেষ সুবিধা পায়, আর সাধারণ মানুষরা বিশেষ সুবিধা পায় না— এজন্যই এই মামলা আজ শুনানির জন্য রেখেছি।
আদালত আরও বলেন, সত্যি বলতে জনমত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা আজ কোথায় এসে ঠেকেছি যে এই একটি মামলার শুনানি হচ্ছে আর সবাই তাকিয়ে আছে। কেন তাকিয়ে আছে? সবার তো ভাবনা-আশঙ্কা— অমুকে অমুকে (আইনজীবী) যখন দাঁড়িয়েছে, অমুক অমুক যখন হয়েছে, তাহলে তমুক তমুকও হইবে (আদালতের আদেশ)। আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কেন সেই ধরনের মামলা আদালতে নিয়ে আসব, যেটা জনমত, আইন ও নীতি-নৈতিকতাকে আদালতে নিয়ে আসবে। আমরা সবাই আদালত থেকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা করি। এটা আমাদের সবার আদালত। এই আদালতকে কিভাবে আমরা পূত-পবিত্র রেখে মানুষকে সেবা দিতে পারি, সেটা দেখতে হবে। আমরা যখন কোনো মামলা নিয়ে আসব, আদালতকে বিতর্কিত করা আমাদের কাজ নয়।
দেশসেরা আইনজীবীদের ‘বিতর্কিত’দের পক্ষ নিয়ে আদালতের দাঁড়ানোর বিষয়টির তীব্র সমালোচনা করেন আদালত। বলেন, কোনো অধ্যাপক বা জ্ঞানতাপসের জন্য আপনারা (আইনজীবীরা) যদি এসে দাঁড়াতেন, কোনো মিডিয়া, ব্যক্তি বা আইনজীবী টুঁ শব্দও করত না। বরং সবাই বলত, ভালোই হয়েছে, তারা (আইনজীবী) ভালো কাজই করেছেন। কিন্তু মিডিয়া বা সাধারণ আইনজীবীরাও দেখেন, যারা একটু বিতর্কিত মানুষ হয়ে যায়, সেটা যেভাবেই হোক, তারা আমাদের সেরা আইনজীবীদের নিয়ে আসেন। তাই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। আজকের এই শুনানির উদ্দেশ্য হলো— আমরা কোন মামলা (আদালতে) আনব আর কোন মামলা আনব না, এটা দেখানো। কারণ এটা আমাদের আদালত। আমাদের আদালতও অনেকের চাপে পড়ে অনেক কিছু করে ফেলে। তাতে যা হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। কেন আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ কথা আসবে? কারণ কিছু না কিছু তো আমরা করি। আমরা এমন কিছুর সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছি।
এরপর আদালত আসামিদের ১০ হাজার পিপিই জরিমানা করে আদালত তাদের আবেদন খারিজ করে দেন। রায়ের পর আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন তার নাম এ মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নেন। আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারও তার আবেদনের জন্য ক্ষমা চেয়ে নাম প্রত্যাহারের আবেদন করেন। পরে আদালত তাদের নাম প্রত্যাহার করে দেন।
তবে আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, মাই লর্ড, কলঙ্ক সবাইকে দিলেন, আমার জুনিয়র দু’জন আছেন, ওনাদের নাম থাকবে। আমি তাদের অ্যাবান্ডান করতে পারব না। কলঙ্ক আমার নামে থাকুক। আই ডোন্ড মাইন্ড। আমি মনে করেছি, এই মামলাটি আমি এনেছি, এটা আনলে দিন আনি দিন খাই যে লয়ার আছেন, তাদের একটা বেনিফিট হবে। যেটা অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেবও বলেছেন। সেজন্য আমি এই মামলাটি নিয়ে আসছি। মামলা এনেছি বলে আমার কোনো দুঃখ নেই। আপনি যদি আমাকে বলতেন, ১০ হাজার কেন, আমি ২০ হাজার পিপিই দিতেও রাজি আছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেবো। যদি মনে করেন আমি ভুল করেছি, তাহলে আমাকে আদেশ দিতে পারেন। কিন্তু আমার ক্লায়েন্টকে নয়। কেননা আমারও একটা বিবেচনা ছিল, যেটার ভিত্তিতে আমি মামলাটি এখানে নিয়ে এসেছি। যাই হোক, এটা আমাদের জীবন।
এ পর্যায়ে বিচারপতি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা যদি সবাই রক্ষা না করি, তাহলে কিভাব হবে? এরই মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের অনেক সর্বনাশ হয়েছে। এমনি আমাদের জুডিশিয়ারির অবস্থা নাজুক। আপনারা এটাকে পারসোনালি নেবেন না।
পরে আদালত রায়ের মধ্য দিয়ে আজকের বিচারিক কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
আরও পড়ুন-
এক্সিম ব্যাংকের এমডিকে গুলি-নির্যাতনের অভিযোগে মামলা
এক্সিমের এমডিকে হত্যাচেষ্টার মামলা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যাখ্যা
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আগাম জামিন আজমালুল হোসেন কিউসি দিপু হক সিকদার বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল বিদেশে থেকে আগাম জামিন ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ ভিডিও কনফারেন্সে শুনানি রন হক সিকদার সিকদার গ্রুপ সিকদার ভাই হাইকোর্ট বেঞ্চ