ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পোশাক খাত, রয়েছে শঙ্কাও!
১ আগস্ট ২০২০ ২৩:৫২
ঢাকা: বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্প। বৈশ্বিক মহামারি করোনা এই শিল্পের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসে। ভাইরাসটির প্রভাবে চলতি বছরের এপ্রিলে পোশাক পণ্যের রফতানি গিয়ে ঠেকে তলানিতে। মাসটিতে মাত্র ৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল, যা ছিল গেল কয়েক দশকের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। অবশ্য পরের দুই মাস মে ও জুনে রফতানি আয় ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। তবে সেটাও ছিল গত বছরের চেয়ে কম। পোশাক পণ্যের রফতানি আয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর এই প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা।
তবে পোশাক খাতের রফতানি আয় নিয়ে শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা। প্রতিবছরের মতো এবারও আগস্ট-সেপ্টেম্বরে রফতানি কম থাকবে বলে তাদের ধারণা। যদিও করোনার প্রভাব কাটিয়ে নতুন করে আসতে শুরু করেছে কিছু ক্রয়াদেশ। আর কী পরিমাণে অর্ডার আসছে তা স্পষ্ট হবে আসছে সেপ্টেম্বরে। এদিকে স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশের বড় একটি অংশও এরই মধ্যে ফিরে এসেছে। পোশাক সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
আরও পড়ুন: পোশাক খাতে সুখবর আসছে আগামী সপ্তাহে
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চে ২২৫ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক পণ্য রফতানি হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। পরের মাস এপ্রিলে রফতানি আয় প্রায় তলানিতে ঠেকে। মাসটিতে ৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি হয়, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮৫ শতাংশ কম। মে মাসে এই আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩ কোটি মার্কিন ডলারে, এই আয়ও পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ৬২ শতাংশ কম। চলতি বছরের জুনে এই আয় বেড়ে ২২৪ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, তবু এখনও পোশাক রফতানি পূর্বের বছরের চেয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। জুন মাসে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতংশের মতো।
এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ৯১ লাখ (২৭ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ; যা মোট রফতানি আয়ের ৮৪ দশমিক ২০ শতাংশ। গত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে পোশাক রফতানি কমেছে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় শুধু পোশাকেই ১০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় কম হয়েছে। গত অর্থবছরে নিট পোশাক রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৩৯০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের। প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ওভেন পোশাক রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৪০৪ কোটি ১১ লাখ ডলার, প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
আরও পড়ুন: পোশাক খাতে সুখবর: ক্রয়াদেশ বহাল রাখছে ক্রেতারা
এদিকে করোনার প্রভাবে গত কয়েকমাসে ৩১৮ কোটি ডলারের পোশাক রফতানির ক্রয়াদেশ প্রাথমিকভাবে বাতিল ও স্থগিত হয়েছিল। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ ফিরে এসেছে, তবে অর্থ পরিশোধের সময় ১৮০ দিন থেকে ২১০ দিন পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে- এমন তথ্য জানিয়েছে বিজিএমইএ। জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখন যে কাজ করছি সেগুলো আগের অর্ডার। সেপ্টেম্বরের আগে বোঝা যাবে না আমরা আসলে কোন অবস্থায় আছি। এখন যে কাজ আছে সেই কাজ দিয়ে আসলে ফ্যাক্টরিগুলো কোনরকমে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘৮০ শতাংশ অর্ডার ফিরে এসেছে এটি আসলে পুরো সত্য নয়। যে অর্ডারগুলো বাতিল হয়েছিল সেগুলো মার্চ-এপ্রিলের। তখনকার কাপড়ের চাহিদা কিন্তু এখন আর নেই। ফলে সেই অর্থে বাতিল হওয়া অর্ডার কিন্তু সেভাবে ফিরে আসেনি। নতুন অর্ডারও খুব একটা এসেছে তা নয়। আমরা এখন অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বরের অর্ডার নিয়ে কাজ করছি। ক্রেতাদের নানাভাবে বোঝাচ্ছি। কতটুকু অর্ডার আসছে তা সেপ্টেম্বরের আগে বোঝা যাবে না।’
বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনায় যে পরিমাণ অর্ডার বাতিল বা স্থগিত হয়েছিল তার বড় অংশই ফিরে এসেছে। আগের কিছু অর্ডারের পণ্য আমরা মে-জুনে রফতানি করেছি। তবে আগামী দুই/তিন মাস যে কাজ করব সে তুলনায় অর্ডার কিন্তু আসেনি। আগামী ২ মাস গত বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ শিপমেন্ট কম হবে। মে-জুন-জুলাইয়ে রফতানি বাড়লেও আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কম হবে। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে বলে এখনও আমরা মনে করতে পারছি না। তবে আমরা চেষ্ট করছি ঘুরে দাঁড়াবার। অক্টোবর-নভেম্বরে নতুন করে অর্ডার আসবে বলে মনে করছি।’
আরও পড়ুন: ৩০০ কোটি ডলারের পোশাক ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেসব অর্ডার বাতিল হয়েছিল সেগুলো আবারও ফিরে আসছে। কিছু কিছু নতুন অর্ডারও আসছে। তবে আগের মতো না। বায়াররা এখনও কনফিউজড। কী হবে তা নিয়ে তারা এখনও শঙ্কায় রয়েছে। মহামারি থেকে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় আসছি, ততক্ষণ আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব না। আমরাও চিন্তিত। কিছু কিছু অর্ডার আসলেও প্রাইস খুবই কম। ক্রেতারা হয়তো তাদের ক্ষতি আমাদের দ্বারা পুষিয়ে নিতে চায়। সব মিলিয়ে পোশাক খাত এখনও আগের ফ্লোতে ফেরেনি।’
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মে ও জুনে পোশাক রফতানি বেড়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা ক্রেতাদের প্রতিশ্রতি রক্ষা করতে পেরেছি। করোনার কারণে পোশাক খাতে সেভাবে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এজন্য শ্রমিকরা অবশ্যই ধন্যবাদ পায়। ক্রেতাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারায় বাংলাদেশের প্রতি তাদের আস্থা বেড়েছে। এখন যে কাজ করছি সেগুলো মে-জুনের অর্ডার। জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর এই সময়ে এমনিতেই পোশাকের অর্ডার কম থাকে। এবারও এমনই থাকবে। তাছাড়া এই সময়টিতে আবার দুটি ঈদ গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে পোশাক কারখানায় ৩ দিনের ছুটি দেওয়া হলেও অনেক কারখানা তাদের শ্রমিকদের ২০ দিন পর্যন্ত ছুটি দিয়ে রেখেছে, কারণ কাজ নেই।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে পোশাকের বিশ্ববাজারই সংকুচিত হয়েছে। চাহিদা কমছে। দরপতন হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। কম্পিটিশনে থেকেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। তবে উদ্যোক্তারা করোনার এই সময়টি সুন্দরভাবে মোকাবিলা করেছেন। যেসব অর্ডার স্থগিত হয়েছে সেগুলোর পুনঃক্রয়াদেশ হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অবশ্য ক্রেতারা ৯০ দিন কিংবা আগামী বছরের একই সময়ে পেমেন্ট দিতে চাচ্ছে। এতে আমরা কিন্তু প্রেশারে থাকব।’
আরও পড়ুন: করোনায় ‘মহাসংকটে’র শঙ্কায় পোশাক খাত
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধীরে ধীরে পোশাক পণ্যের রফতানি আয়ের পার্থক্য কমে আসছে। এখন অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকদের ৭০ শতাংশ ক্যাপাসিটি ব্যবহার হচ্ছে। কারখানাগুলো এখন ভালো অবস্থানে আছে। এ পরিস্থিতিতে এখন তাদের দ্বারাই শ্রমিকদের মজুরি মেটানো সম্ভব এবং নতুন করে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তারা সরকারি সহায়তা ছাড়াই শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারবে। সব মিলিয়ে রফতানি আয় ও কাজের যে প্রবণতা তা খাতটির জন্য খুবই ইতিবাচক।’
অর্থনীতিবিদদের ধারণা, সামনে শীত আসছে। খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড় দিন রয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের ক্রেতা আরও বাড়বে। আর জুনে পোশাক রফতানির অবস্থান খুবই ভালো ছিল; জুলাইয়েও সেই প্রবণতা অব্যাহত থাকে। তাদের মতে, দেশের পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।