চামড়া খাতে রানা প্লাজার মতো ‘ঝাঁকুনি’ দরকার
৪ আগস্ট ২০২০ ১২:০৩
ঢাকা: ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে গত বছরের মতো চিত্র দেখা গেছে এ বছরও। মোটেও দাম মেলেনি পশুর চামড়ার। সরকারের পক্ষ থেকে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও সে দামকেও কেউ পাত্তা দেননি। অনেক জায়গাতেই দুই থেকে তিনশ টাকাতেই বিক্রি হয়েছে গরুর চামড়া, খাশির চামড়ায় মেলেনি একশ টাকাও। এদিকে, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যূনতম কমপ্লায়েন্স না মানার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারাও বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করছে না।
এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের বিকল্প পদ্ধতি চালু করার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে চামড়া সংগ্রহের জন্য এলাকভিত্তিক প্রতিনিধি নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। গরুর হাটের মতো চামড়া সংগ্রহকারীর কাছেও একেকটি এলাকার ইজারা দেওয়া যেতে পারে। আর চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ যেকোনোভাবে নিশ্চিত করতে হবে। সব মিলিয়ে দেশের চামড়া খাতেও ‘রানা প্লাজার মতো’ একটি ‘ঝাঁকুনি’ দরকার বলে মত তাদের।
গেল বছর কোরবানি ঈদে চামড়ার বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। বলা হয়েছিল, চামড়ার দাম সর্বনিম্ন রেকর্ড ছুঁয়েছে। তবে সে রেকর্ড স্থায়িত্ব পায় ওই একবছরই। কারণ এ বছর সরকার চামড়ার দাম আরও কমিয়ে দেয়। তাতেও চামড়ার বাজারের অস্থিরতা কমানো যায়নি। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকার মধ্যেই গরুর চামড়া হাতবদল হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা এক থেকে দুইশ টাকাতেও নেমেছে। আর খাশির চামড়ার দাম নেমে এসেছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়! কোনো কোনো স্থানে এর চেয়ে কমেও চামড়া বিক্রি হয়েছে বলে তথ্য এসেছে। গত বছরের মতো রাস্তায় চামড়া ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে এ বছরও। অনেক কোরবানিদাতা বলছেন, এরকম চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তারা মাটিতে চামড়া পুঁতে ফেলতে বাধ্য হবেন।
চামড়ার বাজারে কেন এই অস্থিরতা? কেন চামড়ার দামে এমন ধ্বস?
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চামড়া তো কাঁচামাল, জরুরি এই কাঁচামালটি নিয়ে সমস্যার পেছনে রয়েছে এর চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা। এ বছর আমাদের নিজেদের দেশ থেকেই চামড়া রফতানিতে ২৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। এছাড়া চামড়ার ৫০ শতাংশ রফতানি হয় চীনে। চীনের বাজারেও এখন চাহিদা নেই। শুধু চীন কেন, বিশ্ব বাজারেই এখন চামড়ার চাহিদা নেই। আগামী বছর যে চামড়ার চাহিদা বাড়বে, সেরকমও মনে হচ্ছে না।
তিনি বলেন, চামড়াজাত পণ্যের বাজারে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ রাখা হলেও বিষয়টি জানানো হয়েছে ঈদের মাত্র দুই-তিন দিন আগে। আবার যে ভারতে রফতানি হবে, সেখানেও এ নিয়ে প্রচারণা চালানো হয়নি। ফলে প্রচারণার অভাবেও ঈরদের সময় চামড়া রফতানির সুযোগটি কাজে লাগানো কঠিন। তবে এই সুযোগ অনির্দিষ্টকালের জন্য, তাই ভারতে বাংলাদেশি হাইকমিশনের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে প্রচারণা চালানো উচিত। দেশে যারা কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে থাকে, তাদের কাছেও বিষয়টি ভালোভাবে পৌঁছানো উচিত।
চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার ও বাংলাদেশের অবস্থান প্রসঙ্গে ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘যে দেশে নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া কেনা হয় না, যেখানে চামড়া ফেলে দেওয়া হচ্ছে, সংগ্রহের ন্যূনতম নিয়ম মানা হচ্ছে না— এমন সাপ্লাই-চেইনে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড-বায়াররা ব্যবসা করতে চাইবে না। সাপ্লাই চেইনের এই ঘাটতিগুলো দূর না হলে, নিয়ম মানা না হলে, কপ্লায়েন্সের ঘাটতি দূর না হলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা দেশের চামড়ার বাজারে প্রবেশ করবে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও দেশের চামড়া খাতেও রানা প্লাজার মতো একটি ঝাঁকুনি দরকার।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘দেশে আসলে গরু বা খাশির চামড়া সংগ্রহের উপায় কী? সরকার দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সেটা তো কাজে দিচ্ছে না। আমি-আপনি তো চামড়া বিক্রি করার জন্য কোরবানি দিচ্ছি না। মাদরাসার পক্ষ থেকে এতিমরা চামড়া সংগ্রহ করে। তারা কিন্তু এখন লাভবান হচ্ছে না। সরকার দাম ঘোষণা করেও লাভ হচ্ছে না। এলাকা বা উপজেলাভিত্তিক দু’দিনের ব্যবসায়ীর জন্ম হয়, তাদের জন্য অনেক সময় ট্যানারির মালিকরাও লাভবান হয় না। বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে যে পশু কোরবানি দেওয়া হয়, সেখান থেকেই চামড়া বিক্রি করা হতে পারে।’
তিনি বলেন, কম দামে চামড়া বিক্রি হলে চামড়ার কোয়ালিটি নষ্ট হবে। কারণ যারা গরু বা ছাগল কোরবানিতে যুক্ত থাকে, তারাই অনেক ক্ষেত্রে চামড়া সংগ্রহে যুক্ত। ভালোভাবে চামড়া সংগ্রহ করতে পারলে তাদেরও লাভ হয়। গত দুই বছর ধরে যেভাবে চামড়ার দাম কমছে, এতে অনেকেই চামড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে অগের মতো সচেতন থাকবে না। এতে চামড়ার গুণগত মান সংগ্রহ পর্যায়েই নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া চামড়ার দাম কম থাকলে একসময় মাদরাসাগুলোও হয়তো চামড়া নিতে আগ্রহী হবে না। এছাড়া দু’দিনের ব্যবসায়ী জন্ম নেওয়ার কারণে ট্যানারির মালিকরাও লাভবান হচ্ছে না। যেখানে ট্যানারির মালিক নেই বা তাদের প্রতিনিধি নেই, সেখানে অন্য একটি শ্রেণি চামড়ার মূল লাভ নিয়ে যাচ্ছে। তাই চামড়া সংগ্রহের প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য করণীয় উল্লেখ করে ড. নাজনীন বলেন, কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে দিতে হবে, যেখান থেকে কোরবানির পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে কোরবানির চামড়াগুলো বিক্রি করা যেতে পারে। অথবা যেভাবে কোরবানির হাট লিজ দেওয়া হয়, সেরকমভাবে নির্দিষ্ট এলাকার জন্য একজন নির্দিষ্ট চামড়া সংগ্রহকারীও নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহেও নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। সেই দাম না মানলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে।
যেভাবেই হোক না কেন, ড. নাজনীন উপযুক্ত মূল্যে যথাযথভাবে চামড়া সংগ্রহ নিশ্চিত দেখতে চান। তিনি বলেন, দাম না পেলে ভবিষ্যতে যদি কোরবানিদাতারা চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে উদ্বুদ্ধ হন, তাহলে একটি বিপুল পরিমাণের কাঁচামাল আমরা হারাব, যা দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঘোষণা দিয়ে চামড়ার দাম কমিয়েও যেহেতু কোনো লাভ হচ্ছে না, তাই পশুর চামড়া নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।